মাওঃ শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে
ইসলামে শিল্প ও সংস্কৃতির ধারণা একটি গভীর এবং বহুমুখী বিষয়। অনেকেই মনে করেন, ইসলাম শিল্প ও সংস্কৃতিকে সমর্থন করে না, কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ইসলামে শিল্প ও সংস্কৃতিকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যা স্রষ্টার একত্ববাদকে তুলে ধরে এবং মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জীবনকে উন্নত করে। ইসলামের মূলনীতি হলো, শিল্প তখনই প্রশংসনীয় যখন তা কোনো ধরনের শিরক (আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন) বা অশ্লীলতার দিকে পরিচালিত না হয়।
ইসলামের শিল্প ও সংস্কৃতির প্রধান ভিত্তি হলো তৌহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদ। ইসলামী শিল্পে কোনো কিছুর উপাসনা বা আল্লাহর সৃষ্টির অনুকরণ করে তাকে উপাসনার প্রতিরূপ হিসেবে তুলে ধরা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এ কারণেই ইসলামে মানব বা প্রাণীর মূর্তি বা প্রতিকৃতি নির্মাণকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো ছবি বা মূর্তি তৈরি করে, কিয়ামতের দিন তাকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং বলা হবে, তুমি যা সৃষ্টি করেছ তাতে জীবন দাও।” (বুখারি)। এই হাদিসের মূল উদ্দেশ্য হলো, মানুষ যেন কোনো সৃষ্টির উপাসনায় লিপ্ত না হয়, বরং তার সমস্ত মনোযোগ যেন একমাত্র স্রষ্টার দিকে নিবদ্ধ থাকে।
ইসলামে অনুমোদিত শিল্পের রূপসমূহ
ইসলামী সংস্কৃতিতে এমন অনেক শিল্পরূপ রয়েছে যা বিকাশ লাভ করেছে এবং মুসলিম বিশ্বকে এক অনন্য পরিচয়ে ভূষিত করেছে। এই শিল্পগুলো মূলত বিমূর্ত (Abstract) এবং প্রতীকী, যা স্রষ্টার অসীমতা ও নিখুঁততার ইঙ্গিত দেয়।
১. ক্যালিগ্রাফি (خطاطي) বা হস্তলিপি শিল্প
ইসলামী শিল্পকলার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ক্যালিগ্রাফি। যেহেতু পবিত্র কুরআন আল্লাহর বাণী, তাই সেগুলোকে অত্যন্ত সুন্দর এবং শৈল্পিকভাবে লিপিবদ্ধ করার একটি ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। ক্যালিগ্রাফি শুধু লেখার পদ্ধতি নয়, এটি একটি আধ্যাত্মিক অনুশীলন। এতে ব্যবহৃত বিভিন্ন শৈলী যেমন—কূফি, নাসখ, সুলুস ইত্যাদি মসজিদের দেয়াল, কুরআনের পাণ্ডুলিপি এবং অন্যান্য ভবনে ব্যবহৃত হয়েছে। ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে আল্লাহ, রাসূল (সা.) এবং কুরআনের আয়াতকে সুন্দরতম রূপে উপস্থাপন করে আল্লাহর মহিমা তুলে ধরা হয়।
২. স্থাপত্যশিল্প
ইসলামী স্থাপত্য হলো মুসলিম সংস্কৃতির এক জ্বলন্ত উদাহরণ। মসজিদ, মাদ্রাসা, প্রাসাদ এবং অন্যান্য স্থাপনায় যে শৈল্পিক রূপ দেখা যায়, তা অনন্য। স্থাপত্যের মূল উপাদানগুলো হলো গম্বুজ, খিলান, মিনার এবং উঠান। বিশেষ করে, মসজিদের মিনার আকাশপানে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতীকী বার্তা দেয়। স্থাপত্যে ব্যবহৃত জটিল জ্যামিতিক নকশা এবং আরবিস্ক (লতাপাতার নকশা) আল্লাহর সৃষ্টির অসীমতা ও ভারসাম্যকে ফুটিয়ে তোলে।
৩. জ্যামিতিক ও আরবিস্ক নকশা
ইসলামী শিল্পে জ্যামিতিক নকশা এবং আরবিস্ক বা লতাপাতার নকশার প্রাধান্য লক্ষণীয়। এই নকশাগুলোতে কোনো সপ্রাণীর চিত্র নেই, কিন্তু রয়েছে নিখুঁত গাণিতিক সামঞ্জস্য। জ্যামিতিক নকশাগুলো গণিত ও শিল্পের এক অসাধারণ সমন্বয়, যা সৃষ্টিজগতের সুশৃঙ্খলতা ও ভারসাম্যকে তুলে ধরে। এই নকশাগুলো মসজিদের মেঝে, দেয়াল, বইয়ের প্রচ্ছদ এবং মৃৎশিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
৪. সাহিত্য ও কবিতা
ইসলামের ইতিহাসে সাহিত্য ও কবিতা ছিল জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার অন্যতম বাহন। জালাল উদ্দিন রুমী, হাফিজ, শেখ সাদী-এর মতো মহান কবিরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে আল্লাহর প্রেম, জীবনের গভীরতা এবং নৈতিক শিক্ষা তুলে ধরেছেন। এসব সাহিত্য শুধু মনের খোরাক জোগায় না, বরং মানুষকে আধ্যাত্মিকভাবেও উন্নত করে।
৫. সঙ্গীত ও নাশিদ
ইসলামে সঙ্গীতের বিষয়ে বিভিন্ন মত থাকলেও, নাশিদ বা যন্ত্রবিহীন গজলকে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। নাশিদ এমন এক ধরনের সঙ্গীত, যা আল্লাহর প্রশংসা, রাসূল (সা.)-এর শানে দরুদ এবং ইসলামিক মূল্যবোধ নিয়ে রচিত হয়। এটি মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে এবং ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে সাহায্য করে।
ইসলাম শিল্প ও সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে না, বরং এটিকে একটি সুনির্দিষ্ট নৈতিক ও আধ্যাত্মিক কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে। ইসলামী শিল্প মানবতাকে নৈতিকতা, শৃঙ্খলা এবং আল্লাহর একত্ববাদের দিকে আহ্বান জানায়। ক্যালিগ্রাফি থেকে স্থাপত্য পর্যন্ত, ইসলামী শিল্প তার নিজস্ব সৌন্দর্য, পরিশীলিততা এবং গভীরতা দিয়ে বিশ্বের দরবারে এক অনন্য স্থান করে নিয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, প্রকৃত শিল্প কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং তা স্রষ্টার মহিমা তুলে ধরার একটি মাধ্যম।
মাশা-আল্লাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা লেখা পড়লাম। সময়োপযোগী এই লেখা উপহার দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ। তৌহিদী জনতার অবদান অনেকেই অস্বীকার করে