স্বর্ণের অভিশাপে মৃত্যুপুরী তানজানিয়ার গ্রাম

গণমঞ্চ ডেস্ক

তানজানিয়ার উত্তরাঞ্চলের নর্থ মারা স্বর্ণের খনি একদিকে যেমন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করছে, অন্যদিকে স্থানীয় মানুষের জন্য নিয়ে এসেছে ভয়াবহ দুর্দশা, নির্যাতন আর মৃত্যু। আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম হু হু করে বাড়ায় এ খনিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, পুলিশি সহিংসতা ও অপহরণের মতো ঘটনা বাড়ছে।

এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে ‘চাচা’ নামের এক যুবকের কথা উল্লেখ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য টাইম।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়ামঙ্গো গ্রামের যুবক চাচা এক রাতে অপহৃত হন। পরে মুখোশধারী লোকেরা তাকে হাত-পা বেঁধে কুমিরভরা মারা নদীর সেতু থেকে উলটো ঝুলিয়ে নির্যাতন করেন। তাদের মূল প্রশ্ন ছিল—কে তার কাছ থেকে স্বর্ণ কিনেছে এবং সাম্প্রতিক খনিসংলগ্ন পুলিশ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তিনি কী জানেন। তিন মাস পর চাচা মুক্তি পেলেও মানসিক ও শারীরিকভাবে এখনো ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, ২০০৬ সাল থেকে নর্থ মারা খনি ঘিরে অন্তত ৯৬ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও শত শত মানুষ আহত হয়েছেন। অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, খনির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ গ্রামবাসীদের ভয় দেখাতে টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড বোমা ব্যবহার করে এবং যে কোনো সময়ে প্রাণঘাতী গুলি চালায়। খনি এলাকায় ছড়িয়ে থাকা বর্জ্য পাথরে সোনার টুকরো খুঁজতে যাওয়া গরিব মানুষেরা মূলত পুলিশের নিশানায় পড়েন।

২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, মারা অঞ্চলের ৮০ শতাংশ মানুষ দিনে সাড়ে তিন ডলারেরও কম আয় করেন। ক্ষুধাই তাদের ঝুঁকিপূর্ণ সোনার খোঁজে ঠেলে দেয়।

২০০২ সালে ওই অঞ্চলে স্বর্ণের খোঁজে বাণিজ্যিক খনন শুরু হয় এবং ২০০৬ সালে কানাডীয় জায়ান্ট ব্যারিক মাইনিং করপোরেশন নর্থ মারায় প্রবেশ করে। ওই সংস্থা ২০১৯ সাল থেকে তানজানিয়া সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে ‘টুইগা মিনারেলস’ নামে একটি খনি উত্তোলন প্রকল্প পরিচালনা করছে।

কোম্পানিটি দাবি করে, খনি থেকে অর্জিত আয়ে রাস্তা, রেলপথ, শিক্ষা ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। তবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা রেইডের ভাষ্যমতে, এটি আফ্রিকার সবচেয়ে প্রাণঘাতী শিল্পখনিগুলোর একটি।

অভিযোগ রয়েছে, সরকার স্বর্ণ থেকে অর্জিত বিপুল অর্থ দিয়ে দমননীতিকে শক্ত করছে। এর ফলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না বিরোধী দল চাদেমা। এ দলের নেতা টুনডু লিসু এখন দেশদ্রোহ মামলায় কারাগারে। দলের অনেক সদস্যকে অপহরণ বা হত্যার শিকার হতে হয়েছে। বিরোধীদের দাবি, স্বর্ণের অর্থ দিয়ে সরকার পুলিশকে অস্ত্রশস্ত্র জোগাচ্ছে।

অন্যদিকে শাসক দল ‘চামা চা মাপিন্দুজি’ (সিসিএম) এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু রয়েছে এবং রাষ্ট্র জনগণের স্বার্থেই কাজ করছে।

তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। পরিবার হারানো, আহত বা নিখোঁজ সদস্যের খোঁজে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এক মা জানান, খনি-পুলিশের হাতে তার দুই ছেলেকে নির্মমভাবে নির্যাতনের পর একজন মারা যান, অন্যজনের এখনো চিকিৎসা চলছে। পরিবার রক্ষার জন্য তাকে গরু বিক্রি ও বাড়ি বন্ধক রাখতে হয়েছে।

একসময় নিরাপদ আফ্রিকান দেশ হিসেবে পরিচিত তানজানিয়া এখন স্বর্ণের অভিশাপে রক্তাক্ত। স্বর্ণের আলোয় উজ্জ্বল হলেও নর্থ মারার গ্রামগুলোতে ছায়া নেমেছে মৃত্যু, ক্ষুধা আর দমন-পীড়ন।

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *