গণমঞ্চ ডেস্ক নিউজ
সাত মাসেও শেষ হয়নি জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি.র (জেসিআইএল) প্রধান নির্বাহী (সিই) শহীদুল হকের অবৈধ নিয়োগের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ। কালক্ষেপণের কারণে এরই মধ্যে কমিটির প্রধানকে সরিয়ে আরেকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরপরও কাজ চলছে কচ্ছপগতিতে। এ নিয়ে নানা শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। তাদের প্রশ্ন-তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করে কি রক্ষার চেষ্টা চলছে সিইকে। কোনো কারণে প্রথম তদন্তকারী বিলম্ব করলেন তদন্ত শেষ করতে। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রভাবশালী কাউকে ‘ম্যানেজ’ করার কারণেই কী পরিকল্পিতভাবে এমন ধূম্রজাল সৃষ্টি।
জেসিআইএলের সিই শহীদুল হকের অবৈধ নিয়োগ নিয়ে গত ২৪ নভেম্বর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয় যুগান্তরে। রিপোর্ট প্রকাশের পর ঘটনা খতিয়ে দেখতে ডিসেম্বরে জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কারণ জনতা ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (জেসিআইএল)।
এদিকে তদন্ত কাজ চলমান অবস্থাতেই আরেকটি অনিয়মের ঘটনা ঘটিয়েছে সিই শহীদুল হক। সম্প্রতি ‘সিকিউরিটস অ্যাক্ট’ অমান্য করে তার হাউজে নতুন ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। জনৈক আনোয়ার হোসেন নামে এক গ্রাহককে ৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার শেয়ার কেনার অনুমোদন দিয়েছেন। যদিও গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে কোনো অর্থ ছিল না। চেক দিলেও নির্ধারিত সময়ে তা প্রত্যাখ্যান হয়েছে। আইন ভেঙে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত গড়িয়েছে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পর্যন্ত। এরপর শহীদুল হকের বিরুদ্ধে সম্প্রতি আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কর্তৃপক্ষ। ওই কমিটি শূন্য ডিপোজিটে ৬ কোটি টাকার শেয়ার কেনার নেপথ্যের কারণ, বাজার কারসাজির উদ্দেশ্যে ছিল কিনা-এসব বিষয় খতিয়ে দেখছে। জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান জনতা ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) মো. রফিকউল্লাহ রোববার যুগান্তরকে জানান, বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করছি যদিও এখনো কাজ শেষ হয়নি। তদন্ত শেষে রিপোর্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হবে। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে এর বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না। বিস্তারিত জানতে হলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।
এর আগেও বিগত সরকারের সময়ে শহীদুল হক দায়িত্বে থাকাকালীন সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে ২০২১ এবং ২০২২ সালে ৪৭৭ কোটি টাকা মুনাফা তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে জেসিআইএলকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে এ ঘটনা উদ্ঘাটনের পর জড়িত চার ব্যক্তি ও পাঁচ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৪২৮ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
জেসিআইএলের সিই অবৈধ নিয়োগসংক্রান্ত তদন্ত কমিটির অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনতা ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্টের চেয়ারম্যান ও জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মজিবুর রহমান যুগান্তরকে জানান, তদন্তটি সঠিকভাবে শেষ করতে সময় নেওয়া হচ্ছে। তবে তদন্তের কাজ এগোচ্ছে। তদন্ত কাজটি ভালোভাবে হোক সেটি আমি চাচ্ছি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্ত ধামাচাপা দিতে কোনো ধরনের তৎপরতা চালিয়ে লাভ হবে না। মাঝে একটু সমস্যা হয়েছে। যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তদন্ত কার্যক্রম চলছে। আশা করছি এর ফলাফল পাওয়া যাবে।
অবৈধ নিয়োগ যেভাবে : ২০২০ সালের শেষ দিকে জেসিআইএলের সিই হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় শহীদুল হককে। চুক্তিভিত্তিক এই নিয়োগে বেতন-ভাতাসহ সর্বসাকুল্যে সরকারের অর্থ গুনতে হয় প্রতি মাসে চার লাখ টাকা। একজন বিকম পাশ কোর্সে তৃতীয় শ্রেণি প্রাপ্ত ডিগ্রিধারী শহীদুল হককে নিয়োগ দেওয়া জেসিআইএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে। সিই পদে নিয়োগের সময় নিজের আত্মীয় পরিচয়ে সব ধরনের বিধিবিধান এবং নিয়োগ শর্ত উপেক্ষা করেছেন জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. এসএম মাহফুজুর রহমান। তিনি (মাহফুজুর রহমান) নিজেও সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো এবং এস আলমকে ঋণের নামে একচেটিয়া লুটপাটের সুযোগ করে দিয়ে জনতা ব্যাংককে পঙ্গু করে দিয়েছেন বিগত সরকারের সময়।
গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জেসিআইএলের সিই (চিফ এক্সিকিউটিভ) পদে নিয়োগের জন্য ২০২০ সালে ২০ সেপ্টেম্বর একটি ইংরেজি দৈনিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। প্রার্থীর যোগ্যতা হিসাবে চাওয়া হয় ৩-৪ বছরের স্নাতকসহ ইকনোমিক/ফাইন্যান্স/ব্যাংকিং/অ্যাকাউন্টিং/ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর এবং সঙ্গে এফসিএ/এফসিএমএ/এফসিসিএ। এছাড়া অন্যান্য শর্তের মধ্যে পেশাগত অভিজ্ঞতা সর্বনিম্ন ১৫ বছর, এরমধ্যে মার্চেন্ট ব্যাংকের অভিজ্ঞতা ৫ বছর এবং বয়স হতে হবে ৪৫-৫৫ বছরের মধ্যে। এছাড়া নিয়োগ বিধি অনুযায়ী কোনো পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণি থাকলে তা অযোগ্যতা হিসাবে বিবেচিত হবে।
জানা গেছে, জনতা ব্যাংকের ২০২০ সালের ৬৩৭তম পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেসিআইএলে সিই নিয়োগের জন্য শহীদুল হকসহ তিনজন প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকেন তৎকালীন নিয়োগসংক্রান্ত কমিটি। কমিটির সভাপতি ছিলেন ড. এসএম মাহফুজুর রহমান।
আরও জানা গেছে, পর্ষদের নিয়োগসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের নথি কমিটির প্রথম সুপারিশ ছিল মোহাম্মদ আলী নামের এক প্রার্থী। দ্বিতীয় সুপারিশ ছিল গোলাম কিবরিয়া। আর তৃতীয়জন ছিলেন শহীদুল হক। তার (শহীদুল) প্রসঙ্গে নিয়োগ কমিটির সুপারিশে বলা হয়-‘বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পেশাগত যোগ্যতা যথাযথ রয়েছে। মার্চেন্ট ব্যাংকের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। তবে বয়স কম ও মোট ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। বিকম (সম্মান) এর স্থলে বিকম (পাশ) এবং বি.কম (পাশ) এর তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জনতা ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী তিনজন প্রার্থীর মধ্যে কেউ নিয়োগের যোগ্য নয়। আবার তিনজন প্রার্থীর মধ্যে তুলনামূলক কম যোগ্য প্রার্থী ছিলেন বর্তমান সিই শহীদুল হক। কিন্তু সব বিধান ভেঙে সিই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল শহীদুল হককে।
তবে নিজের যোগ্যতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা কম-এমন প্রশ্ন যুগান্তরের পক্ষ থেকে ইতঃপূর্বে পরপর দুবার যোগাযোগ করা হয় অভিযুক্ত শহীদুল হকের সঙ্গে। প্রতিবারই তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘অভিযোগ সঠিক নয়। সব নিয়ম মেনেই আমার নিয়োগ হয়েছে। ইন্টারভিউ, স্ক্রুটিনি ও সব ধরনের বিধান অনুসরণ করেই সেটি হয়েছে। প্রয়োজনে অনুসন্ধান করে দেখতে পারে সরকার।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শহীদুল হকের অবৈধ নিয়োগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এর আগে জনতা ব্যাংকের বোর্ড সভায় একটি সিদ্ধান্ত হয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বোর্ডের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অদৃশ্য কোনো প্রভাব কাজ করছে কিনা সেটি দেখতে হবে। যদিও বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ একমত এ ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু এখন চলছে ২০২৫ সালের আগস্ট। কিন্তু তদন্ত শেষ হয়নি, শহীদুল হকও রয়েছেন বহাল তবিয়তে।