মিয়া সুলেমান, (বিএ অর্নাস, এমএ ইংলিশ, বিএড টিচিং, এমএড-চলমান) শিক্ষানুরাগী ও সাংবাদিক
একদা একসময় দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোগে। স্থানীয় মানুষের উদ্যোগে গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানে ধীরে ধীরে প্রধান শিক্ষক, শিক্ষক ও সহকারী কর্মচারী নিয়োগ, ভবন নির্মাণ, খেলাধুলা, সংস্কৃতি ও অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। এভাবে এগুলো বড় হতে হতে এক সময় সরকারীকরণের তালিকাভুক্ত হয়।
১৯৭৩ ও ২০১৮ সালে দুই ধাপে সরকার প্রায় আড়াই হাজারের বেশি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা সরকারি করেছিল। তবে এবার জাতীয়করণের ক্ষেত্রে ভিন্নধর্মী নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে, যা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে
কঠোর নীতিমালার জটিলতা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে সরকারের ২০১৮ সালের নীতিমালা অনুসারে—
প্রতিষ্ঠানের বয়স হতে হবে ন্যূনতম ১৫ বছর, প্রধান শিক্ষককে হতে হবে এমপিওভুক্ত ও অন্তত ১২ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, এবং শিক্ষক নিবন্ধন সনদপ্রাপ্ত। কিন্তু দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক এখনো অবসরকালীন বয়স ৫৯ পূর্ণ করেননি। এর বাইরে অনেক প্রধান শিক্ষকই শিক্ষক নিবন্ধন সনদধারী নন, এমনকি নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশও নেননি। ফলে বর্তমান নীতিমালা অনুসারে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষকের যোগ্যতার অভাবে জাতীয়করণের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
প্রধান শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক বিবেচনা ও আর্থিক লেনদেন প্রাধান্য পেয়েছে। এর ফলে বহু অযোগ্য ব্যক্তি প্রধান শিক্ষক হয়েছেন, যারা এখন জাতীয়করণের বড় বাধা। সাধারণত এসব অযোগ্য ও ক্ষমতাহীন প্রধান শিক্ষক টিকে থাকার জন্য রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকেন। অনেকে আবার নামসর্বস্ব শিক্ষক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে দাপট দেখান।
বিগত ২৫ বছরে দেশে প্রায় ৩৫টির বেশি শিক্ষক সংগঠন হয়েছে। এর মধ্যে ১০টিরও বেশি কেবল কাগজে-কলমে অস্তিত্বশীল। এরা শিক্ষক সমাজের জন্য কোনো কার্যকর ভূমিকা না রেখে বরং সুবিধা নিয়েই ব্যস্ত। অনেক সংগঠন সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে জাতীয়করণের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে।
বাস্তবে মাঠপর্যায়ের শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ ও কার্যকর সংগঠন নেই বললেই চলে। যে কয়টি আছে, তারাও প্রায় সবাই নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যতিব্যস্ত। ফলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে সঠিক দাবি-দাওয়া যথাযথভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে না।
বর্তমান শিক্ষকদের দাবি-
এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে শিক্ষকদের প্রধান দাবি—পূর্ণ উৎসব ভাতা, বাড়ি ভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা এবং অন্যান্য সুবিধা। কিন্তু সরকারের সঙ্গে আলোচনায় এসব দাবি শক্তভাবে তোলা হচ্ছে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের মাধ্যমে দেশের শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষক মর্যাদা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু অযোগ্য প্রধান শিক্ষক ও নামসর্বস্ব শিক্ষক সংগঠনের কারণে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।
সরকার যদি প্রকৃতপক্ষে আন্তরিক হয়, তবে—
প্রধান শিক্ষকের যোগ্যতার শর্ত শিথিল করতে হবে,
প্রধান শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং প্রবেশ পর্যায়ের মতো প্রধান ও সহ-প্রধান নিয়োগ প্রক্রিয়াও এনটিআরসিএ কর্তৃক পরিচালনা করতে হবে। এভাবে দেশের ৯৭% শিক্ষার মান বাঁচানো সম্ভব বলে মনে করেন শিক্ষানুরাগী ও সাংবাদিক মিয়া সুলেমান।
বাংলাদেশে শিক্ষা খাতকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিদ্যমান অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
২০২৪ সালের ১৪ মে পর্যন্ত দেশে ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা ৪,৫৫৪। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়নে চার ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা যেতে পারে (যেখানে একাধিক আছে সেগুলোকে মার্জ করা যেতে পারে):
একটি আলিয়া মাদ্রাসা (ফাজিল পর্যন্ত শিক্ষা),
একটি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ (এইচএসসি পর্যন্ত শিক্ষা),
একটি সহশিক্ষামূলক উচ্চ বিদ্যালয় (এসএসসি পর্যন্ত শিক্ষা),
একটি ডিগ্রি কলেজ (এইচএসসি থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত শিক্ষা)।
এভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে মোট ১৮,২১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে।
প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হলে ডিপ্লোমা পর্যায়ের সব ধরনের কোর্স চালু করা যাবে। একইসাথে ডিগ্রি ও অনার্স পর্যায়ের জন্য বিশেষায়িত কলেজ রাখা যেতে পারে।
জেলা শহরে জনমিতি ও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিন্যাস করা হবে। আর বিভাগীয় পর্যায়ে থাকবে—
কামিল মাদ্রাসা (১ম শ্রেণি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত),
একটি নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কলেজ (মাধ্যমিক থেকে মাস্টার্স),
একটি সহশিক্ষামূলক জেনারেল কলেজ (ইন্টার থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত শিক্ষা)।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলে উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য হবে। একই সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটবে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বাড়বে এবং শিক্ষার মানে আসবে নতুন গতি।