লুটপাটে ধ্বংসের পথে ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর

সিলেটের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরে পাথর লুটপাটের ঘটনায় পরিস্থিতি চরমে পৌঁছেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই লুট চলমান থাকলেও গত দুই সপ্তাহে তা রীতিমতো ভয়াবহ আকার নিয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিএনপি ও যুবদল নেতাদের নেতৃত্বে পাথর উত্তোলন চলছে, পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও এতে জড়িত। পরিবেশবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে পর্যটন স্পটটি হারিয়ে যেতে পারে এবং সরকার বিপুল রাজস্ব হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে দিনদুপুরে খোলাখুলি চলছে পাথর উত্তোলন ও লুটপাট। ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বাঙ্কার এলাকাও বাদ যাচ্ছে না। স্থানীয়দের মতে, গত দুই-তিন মাসে অন্তত এক হাজারের বেশি বারকি নৌকা দিয়ে পাথর বহন করা হয়েছে, অথচ পুলিশ প্রশাসন কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল।

স্থানীয়দের বর্ণনায়, হাজার হাজার শ্রমিক দিন-রাত সমানতালে কোদাল, বেলচা, শাবল ও টুকরি নিয়ে কোয়ারি এলাকায় গিয়ে পাথর উত্তোলন করেন। পরে বারকি নৌকায় তা মিলমালিকদের কাছে বিক্রি হয়, যেখানে মেশিনে ভেঙে ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করা হয় এবং ট্রাক-পিকআপে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।

২০১৭ সালে পাহাড়ি ঢলে ধলাই নদীর উৎসমুখে প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে জমা হওয়া পাথরের স্তূপ সংরক্ষণ করে জনপ্রিয় পর্যটন স্পটে রূপ নেয় সাদা পাথর। পরবর্তীতে কয়েক দফা ঢলে আরও পাথর জমা হয় এবং উপজেলা প্রশাসন ধারাবাহিকভাবে এলাকা রক্ষা করে। ইউএনও সুমন আচার্যের উদ্যোগে একটি মহাপরিকল্পনাও তৈরি হয়, তবে তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় বর্তমানে এলাকা ঝুঁকির মুখে।

চাঁদাবাজির নতুন কৌশল
আগে নৌকাপ্রতি ১,৫০০–২,০০০ টাকা চাঁদা এবং পুলিশের জন্য আলাদা ৫০০–১,০০০ টাকা দিতে হতো। কিন্তু এখন চাঁদা নেওয়ার পরিবর্তে শর্ত রাখা হয়েছে— উত্তোলিত পাথর শুধু সিন্ডিকেট সদস্যদের কাছেই বিক্রি করতে হবে, সর্বোচ্চ ১,৫০০ টাকা দরে। এতে লুটের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের হাতে চলে গেছে।

প্রশাসনের কাছে লুট হওয়া পাথরের সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তবে স্থানীয়দের ধারণা, গত এক বছরে সিলেটের পাথর কোয়ারি বহির্ভূত স্থান থেকে ২,০০০–৩,০০০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে।

অভিযোগ ও প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় বিএনপি ও যুবদল নেতাদের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উঠলেও, সিলেট জেলা যুবদলের সহসাধারণ সম্পাদক বাহার আহমদ রুহেল দাবি করেছেন, লুটে জড়িতদের বেশিরভাগই সিলেটের বাইরের লোক এবং তাদের সঙ্গে দলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী জানিয়েছেন, দলের কেন্দ্রীয় নির্দেশে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং প্রমাণ মিললে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম চৌধুরী কিমের মতে, বিগত দেড় দশকে যত পাথর লুট হয়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ঘটেছে গত এক বছরে। তার দাবি, প্রশাসনের ব্যর্থতাই এই অবস্থা তৈরি করেছে এবং পরিবেশ উপদেষ্টাও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

প্রশাসনের অবস্থান
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের মাহমুদ আদনান বলেছেন, পাথর উত্তোলনের খবর পেলে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বিশেষ টাস্কফোর্স অভিযান চালায়, যেখানে পুলিশ সহযোগিতা করে। তবে পুলিশের পক্ষে একা এটি ঠেকানো সম্ভব নয়। সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ জানিয়েছেন, জনবল সংকট থাকলেও নিয়মিত অভিযান চলছে এবং জনবল বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *