রূপপুর প্রকল্পে দ্বিগুণ ব্যয়, নেই অনুমোদনের নথি

গণমঞ্চ নিউজ ডেস্ক –

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্পগুলোর একটি। দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে এটি একদিকে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রতীক, অন্যদিকে সরকারের মর্যাদার প্রকল্প হিসেবেও প্রচারিত। কিন্তু প্রকল্পটি ঘিরে শুরু থেকেই নানা বিতর্ক ও অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। সর্বশেষ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে অস্বচ্ছতা, অনুমোদনবিহীন সিদ্ধান্ত, অতিরিক্ত ব্যয় এবং অর্থ ব্যবস্থাপনায় অসঙ্গতির বিস্তারিত চিত্র।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক চুক্তি অনুযায়ী রূপপুরে প্রতিটি ১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট নির্মাণ করে মোট ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের চূড়ান্ত চুক্তিতে প্রতিটি ইউনিটের ক্ষমতা বাড়িয়ে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট করা হয়। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ধরা হয় ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট।

তবে নিরীক্ষকরা অভিযোগ করেছেন, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুমোদন কোথা থেকে এসেছে, কোন বৈঠকে বা কোন পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে— এমন কোনো নথি পাওয়া যায়নি। ফলে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি অস্বচ্ছ রয়ে গেছে।

ক্ষমতা বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্তের কারণে প্রকল্পের ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। প্রাথমিক অনুমান ছিল প্রায় ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পরে খরচ দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা। অথচ খরচ বাড়ানোর যৌক্তিকতা, আলোচনার প্রক্রিয়া কিংবা অনুমোদনের লিখিত প্রমাণ কোনো কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

২০১২ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে বৈঠক করে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণে একটি সমঝোতা দল গঠন করা হয়। এতে অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, বিদ্যুৎ বিভাগ ও পরমাণু শক্তি কমিশনের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন। তাঁদের দায়িত্ব ছিল রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে খরচ চূড়ান্ত করা।

কিন্তু ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে কোনো আলোচনার কার্যক্রমের নথি পাওয়া যায়নি। বরং ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর সরাসরি রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের সঙ্গে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই হয়। এর আগে প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য আরও চারটি চুক্তি করা হয়েছিল, যার মূল্য ছিল প্রায় ০.৫৪৫৯ বিলিয়ন ডলার। ফলে মোট খরচ দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার।

রাশিয়ার তিনটি শহরে যন্ত্রপাতি পরীক্ষার জন্য কোয়ালিটি ইন্সপেকশন ইউনিট ভাড়া করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারি নথিতে দেখা যায়, একই সময়ে ইন্সপেকশন টিমকে হোটেলে রাখা হয়েছে দেখিয়ে আলাদা ভাড়া বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে শুধু হোটেল খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। সিএজির প্রতিবেদনে এটিকে ‘অযৌক্তিক ব্যয়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ছাড়া প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাছান (বর্তমানে এনপিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক) রাশিয়ায় আবাসন ভাড়ার নামে ৭৭ লাখ টাকার বেশি নগদ অর্থ তুলেছেন। অথচ প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির নির্দেশনা ছিল, এসব খরচ বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। নিয়ম ভেঙে সরাসরি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে ব্যয় করা হয়। এই অর্থ যথাযথভাবে সমন্বয় হয়েছে কিনা—সেটিরও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ায় ভিভিআর-১২০০ প্রযুক্তির পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রতি কিলোওয়াটে খরচ হয় ৪ হাজার ৭৫ ডলার। অথচ রূপপুরে খরচ হচ্ছে ৫ হাজার ৮৯০ ডলার। একই প্রযুক্তিতে ফিনল্যান্ডে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ডলার আর তুরস্কের আক্কুইউ প্রকল্পে মাত্র ৩ হাজার ২০০ ডলার। ফলে তুলনায় রূপপুর প্রকল্প উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যয়বহুল।

প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)ও অনুসন্ধান শুরু করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয় ও টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তবে অতীতে রূপপুর প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটম ও ঢাকায় রাশিয়ান দূতাবাস অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, “পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি জাতীয় মর্যাদার প্রকল্প। কিন্তু এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা প্রশ্ন তোলে। সঠিক তদন্ত হওয়া জরুরি।”

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “শুরু থেকেই প্রকল্পটি বিতর্কিত। প্রতিযোগিতা ছাড়া রাশিয়ার হাতে এত বড় প্রকল্প দেওয়া হয়েছে, যার দুর্নীতির রেকর্ড আন্তর্জাতিক অঙ্গনেই প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু সরকারকে দোষারোপ করলে চলবে না, জড়িত আমলাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।”

রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি ইতোমধ্যে ৯৫ শতাংশ হয়েছে। প্রকল্পটি এ বছর উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও তা এক বছর পিছিয়েছে। রাশিয়া প্রকল্পের ৯০ শতাংশ ঋণ জোগাচ্ছে।

তবে প্রকল্প ঘিরে যে প্রশ্নগুলো উঠছে— অতিরিক্ত ব্যয়, অনুমোদনবিহীন সিদ্ধান্ত, আর্থিক অনিয়ম—সেগুলোর সুনির্দিষ্ট জবাব এখনও মেলেনি।

এসব বিষয় জানতে প্রকল্পের পরিচালক ড. কবির হোসেনের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে ‘রুপপুর প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি এবং সেসব নথি’ বিষয়ে প্রশ্ন আছে লিখে ম্যাসেজ পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *