মাওঃ শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে
প্রাকৃতিক সম্পদ, যা আল্লাহ তা’আলা মানবজাতির কল্যাণের জন্য দান করেছেন, তা জনগণের আমানত। পবিত্র ইসলাম ধর্ম এই আমানতের রক্ষণাবেক্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। যেকোনো ধরনের দুর্নীতি, লুটপাট বা অবৈধভাবে জনগণের সম্পদ দখল করাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে এই অবৈধ কাজের ভয়াবহতা ও এর পরিণাম সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
জনগণের সম্পদ: আল্লাহর আমানত
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে, দেশের সম্পদ কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নয়; বরং তা সমগ্র জাতির সম্পদ, যা আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত। এই সম্পদ রক্ষা করা প্রত্যেকের ঈমানী দায়িত্ব। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে ফিরিয়ে দাও।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৮)
এখানে “আমানত” শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যার মধ্যে জনগণের অধিকার, সম্পদ ও রাষ্ট্রের সম্পদ অন্তর্ভুক্ত। এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, রাষ্ট্রের সম্পদ ভোগ-দখলের ক্ষেত্রে যারা দায়িত্বশীল, তাদের জন্য তা আমানতস্বরূপ। এই আমানতে কোনো ধরনের খেয়ানত করা ইসলামে গুরুতর অপরাধ।
দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে কোরআনের কঠোর হুঁশিয়ারি
কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বিভিন্ন আয়াতে মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন: “আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং মানুষের সম্পদের কিয়দাংশ জেনে-বুঝে অবৈধ পন্থায় গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারকদের কাছে পেশ করো না।” (সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ১৮৮)
এই আয়াতে ঘুষ, দুর্নীতি, মিথ্যা মামলা বা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করতে নিষেধ করা হয়েছে। যারা এই ধরনের কাজে লিপ্ত হয়, তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে বড় অপরাধী।
হাদিসের আলোকে লুটপাটের ভয়াবহতা
রাসূলুল্লাহ (সা.) তার বিভিন্ন হাদিসে জনগণের সম্পদ আত্মসাৎকারীদের জন্য কঠিন শাস্তির কথা বলেছেন। তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি আমাদের প্রতি প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” (সহীহ মুসলিম)
জনগণের সম্পদ লুটপাট বা দখল করা এক প্রকার প্রতারণা, যা রাসূল (সা.) এর উম্মতের বৈশিষ্ট্য নয়। আরেকটি হাদিসে তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে ওই সম্পত্তির সমান সাতগুণ জাহান্নামের আগুনের মধ্যে ডুবিয়ে রাখবেন।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, কোনো ব্যক্তির সম্পদ অবৈধভাবে দখল করলে তার জন্য আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে। দেশের সম্পদও যেহেতু জনগণের সম্মিলিত সম্পত্তি, তাই তা আত্মসাৎ করলে এর পরিণাম আরও ভয়াবহ হতে পারে।
ইসলামে ন্যায়বিচার ও কঠোর শাস্তির বিধান
ইসলামী শাসনব্যবস্থায় জনসম্পদ লুটপাটকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। খলিফারা তাদের শাসনামলে এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বাইতুল মাল (রাষ্ট্রীয় কোষাগার)-এর সম্পদকে তারা জনগণের আমানত হিসেবে দেখতেন এবং এর অপব্যবহারকারীদের কঠোর শাস্তি দিতেন। খলিফা উমর (রা.)-এর শাসনামলে দেখা গেছে, তিনি প্রাদেশিক গভর্নরদের সম্পদ ও জীবনযাপনের ওপর কড়া নজর রাখতেন, যাতে কোনো ধরনের দুর্নীতি বা অপচয় না ঘটে।
ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে, জনগণের সম্পদ লুটপাট বা অবৈধভাবে দখল করা একটি জঘন্য অপরাধ। এটি কেবল রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনই নয়, বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশনারও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একজন প্রকৃত মুমিনের দায়িত্ব হলো, এই ধরনের অনৈতিক কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং সমাজের অন্য কেউ এই ধরনের কাজে লিপ্ত হলে তার প্রতিবাদ করা। আমানতের সঠিক ব্যবহার এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের মূল শিক্ষা। আল্লাহ আমাদের সকলকে এই শিক্ষা মেনে চলার তৌফিক দান করুন।