রাষ্ট্রযন্ত্র যখন প্রতিপক্ষ: আমলাতন্ত্রের চালে আটকে যাওয়া অন্তর্বর্তী সরকার

বাংলাদেশ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে থাকা একটি রাষ্ট্র। এখানের জনসাধারণ অধিকার আদায়ে, অন্যায় ও অনিয়মের শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিতে রক্ত দেয় প্রতিনিয়ত। কিন্তু পরিবর্তন আটকে থাকে একটি বিশেষ মহলের হাতে। যেটা থেকে পরিত্রানের উপায় কেউ খুঁজে পায় না! আমি বলবো পরিবর্তনের জন্য একজন “মাহাথির মোহাম্মদ” এর প্রয়োজন। তার মতো বিশেষ কৌশল ও ক্ষমতা প্রয়োগ করা এখন সময়ের দাবী। এর চেয়ে উৎকৃষ্ট পদ্ধতি আর হতে পারে না।

বাংলাদেশ,একটি দেশ যার জন্ম হয়েছিল একটি স্বপ্ন নিয়ে— অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, সুন্দর, সুশীল ও কার্যকর রাষ্ট্রের জন্য। কিন্তু আমরা স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এসেও দেখছি বর্তমানে এখানে আমলাতন্ত্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল হতাশা ও ক্ষোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, এই আমলাতান্ত্রিকতার বলয় শক্তিশালী করা হয়েছে স্বৈরশাসন পাকাপোক্ত করতে। জনগনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান তথা ছাত্রদের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। এদেশে রাজনৈতিক প্রভাব, আমলাদের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত, এবং নাগরিক সেবার নামে দীর্ঘসূত্রিতা ও হয়রানি—এগুলো এখনও নিত্যদিনের সমস্যা। শুধু সমস্যা হলে কথা ছিলনা। এটির পেছনে লুকায়িত রয়েছে রাজনৈতিক এজেন্ডা ও দুর্বৃত্তায়নের কৌশল। রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহৃত হয় আমলাতান্ত্রিকতা। ‘এজ লাইক গিভ এন্ড টেক’

বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার পেছনের কারণ, জনগণের উপর এর প্রভাব ও সরকারকে ব্যার্থ করার অপচেষ্টা কিভাবে চালানো হয় সেটা হয়তো অনেকেই জানে না। আবার অনেকে জানলেও সেটি প্রতিহত করার কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কাউকেই। আজ চলুন জেনে নেই;

১.আমলাতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বেচ্ছাচারিতা:

বাংলাদেশের আমলারা এখন আর শুধু নীতিভ্রষ্ট নন; অনেক ক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক অভিসন্ধি ও স্বার্থ চরিতার্থ করার মূল হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে নিজেদের অনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য।

বর্তমানে, আমলারা তাদের দায়িত্ব পালনের বদলে রাজনৈতিক নেতাদের মতো আচরণ করছেন, যা সরাসরি রাষ্ট্রের কার্যকারিতা ও নাগরিক অধিকারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

যদি কেউ তাদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে বলতে যায় তাঁদের অনেকেই বলে বসেন “নিজ চরকায় তেল দেন”—অর্থাৎ, শুধু নিজের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করুন সমষ্টিগত সমস্যা চিন্তা করার আপনার দরকার নেই, অন্য কারও সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমলাদের এই মনোভাব নাগরিক সেবাকে আরও অকার্যকর করে তুলছে। সচেতন ব্যক্তিদের কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে। কারণ সচেতন ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এই আমলাদের হাতে ন্যাস্ত রাখা হয়েছে।

২. নাগরিক সেবায় দীর্ঘসূত্রিতা ও ইচ্ছাকৃত জটিলতা:

সরকারি সেবা গ্রহণ করতে গিয়ে জনগণকে অত্যন্ত ধীরগতি, জটিল প্রক্রিয়া এবং হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। জন্ম নিবন্ধন, মৃত্যু নিবন্ধন, ভূমি নিবন্ধন, মিউটেশন, ট্যাক্স প্রদান সহ—প্রায় সব ক্ষেত্রেই নাগরিকদের অসহায়ত্ব বেড়েই চলেছে।

অনেক ক্ষেত্রে আমলারা জটিল ও দুর্ভেদ্য নীতিমালা প্রণয়ন করেন, ডিজিটাল সেবায় ইচ্ছাকৃতভাবে সার্ভার জটিলতা তৈরি করেন, অনলাইন সেবাকে কৃত্রিমভাবে ধীরগতির রাখেন, এবং নতুন সফটওয়্যার প্রবর্তনের নামে সময় ও অর্থের অপচয় করেন। এর ফলে “ডিজিটাল বাংলাদেশ” গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

পলাতক শেখ হাসিনা’র ভাষ্য মতে, “ডিজিটাল বাংলাদেশ” এর সাথে জনগনকে পরিচিতি করে তূলেছে বলে দাবী করতো আর তাই শেখ হাসিনা ছাড়া তাঁর আমলারা সেটাকে কিভাবে বাস্তবায়ন হতে দিতে পারে! তাই জগাখিচুরি মার্কা ডিজিটাল প্লার্টফর্মে চলছে সব জায়গায় সেবার নামে প্রহসন।

৩. স্থানীয় সরকার কাঠামোয় অব্যবস্থাপনা:

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন: পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ,) অদক্ষতা ও অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের কারণে তাদের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। অনৈতিক লেনদেন ও ঘুষ বানিজ্যের রমরমা ব্যবসা করছে আমলা ও সরকারী কর্মচারীরা। সেই সাথে স্থানীয় সরকারের দুর্বল ব্যবস্থাপনা সরাসরি নাগরিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যেহেতু স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি এখন নেই বললেই চলে, আবার যারা আছে তাঁদের বেশিরভাগের ঘাড়ে স্বৈরাচারের দোসর তকমা লাগানো আছে।

৪. এনআইডি ব্যবস্থার স্থবিরতা ও নাগরিক জীবনে এর প্রভাব:

নির্বাচন কমিশনের এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) নিবন্ধন ও সংশোধন প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতির এবং জটিল। এর ফলে:
. অনেকেই পাসপোর্ট পাচ্ছেন না, ফলে বিদেশ যাওয়া বা চাকরি পাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
· পিতা/মাতার এনআইডি সংশোধন না হলে সন্তানের নিজের এনআইডি তৈরি হচ্ছে না।
· চাকরিদাতারা এনআইডি ছাড়া চাকুরীতে নিয়োগ দিচ্ছেন না, ফলে সুযোগ থাকা স্বত্ত্বেও অনেকেই বেকার হয়ে পড়ছেন।

এই সমস্যা সমাধানে আমলাদের উদাসীনতা (“আপনি নিজ চরকায় তেল দেন”) অনেক জায়গায় এমন শুনতে হয়েছে অনেকেই, এটি সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।

৫. পরিবেশ সংক্রান্ত রীট ও ভূমি ব্যবস্থাপনার জটিলতা:

পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসানের চব্বিশ পূর্ববর্তী একটি রীটের কারণে বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই ভূমি ব্যবস্থাপনা আগের তুলনায় আরও জটিল হয়ে পড়েছে। সরকারি সিকস্তি, জলাভূমি, নদী, খাল—এগুলো থেকে পরবর্তীতে ব্যক্তি মালিকানায় পরিবর্তিত সম্পত্তির রেকর্ড হওয়া বৈধ ছিলনা বলে দাবী উপদেষ্টার কিন্তু আজ সত্তর বছর পর এসে সেই সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়ন হবে সেটা কারও বোধগম্য নয়। বরং এই সিদ্ধান্ত একটি গনবিরোধী কার্যকলাপ হিসেবে প্রতিয়মান হয়েছে। যে কারণে অনেক মালিকানা সম্পত্তি রেকর্ড সংশোধন ও হস্তান্তর প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু ভূমি সিএস রেকর্ড বা ব্রিটিশ জরিপের সময় বিদ্যমান সিকস্তি ও নদীর অংশ ক্রমেই বর্ধিত রুপে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় ব্যক্তি মালিকানায় পরিবর্তিত হয়, যেগুলো পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের জন্য কাজ করেছে সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান এর সংগঠন ‘বেলা’। যদিও সেই রীটের পেছনে পরিবেশ, জীব বৈচিত্র্য ও নদী সংরক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু বাস্তবতা হলো—এটি সামগ্রিক ভূমি হস্তান্তর, নিবন্ধন ও কর আদায়কে এক প্রকার অচল করে দিয়েছে অনেক জায়গায়। অনেক সাধারণ মানুষ তাদের বৈধভাবে কেনা জমিরও মালিকানা নিবন্ধন করতে পারছেন না। প্রশ্ন হচ্ছে যেটি এতদিন বৈধ ছিল তা হঠাৎ করে কিভাবে অবৈধ হয়!

৬. আয়কর নীতিমালায় অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত ও কর আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব:

আয়কর বিভাগ ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে ভূমি নিবন্ধনে উৎসকর (গেজেট) নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, কিন্তু এটি করতে গিয়ে তারা সংশ্লিষ্ট (ভূমি মালিক, রেজিস্ট্রি অফিস, উন্নয়ন সংস্থা) এদের কারও সাথে কোনও পরামর্শ করেনি। ফলস্বরূপ:

· অনেক এলাকায় ভূমি নিবন্ধন কমে গেছে।
· কর আদায় আগের তুলনায় কমেছে।
· কিছু এলাকার ক্ষেত্রে উৎসকর ১৪৭% পর্যন্ত বেড়ে গেছে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং নাগরিকদের জন্য বোঝা হিসেবে কাজ করছে। আয়কর বিভাগ জানয়েছে ২০২৫-২০২৬ অর্থ বছরে ভূমি নিবন্ধনে উৎস কর কমানো হয়েছে কিন্তু বাস্তবতা হলো ভিন্ন আগে যেখানে ১২১২১ টাকা সেখানে এখন ৩০০০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে৷ অপরদিকে, অর্থ উপদেষ্টাকে দিয়ে সেই ভিত্তিহীন বিবৃতি প্রদান করানো হয়েছে যা বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে।
. জটিল ও বোধগম্য নয় এমন আয়কর নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে যেগুলো সাধারণের জন্য আর্থিক ক্ষতি ও দুর্নীতির বিস্তারকে আরও প্রশস্ত করে তুলছে।

৭. ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ইচ্ছাকৃত বাধা:

“ডিজিটাল বাংলাদেশ” লক্ষ্যকে ধ্বংস করার জন্য আমলারা বিভিন্ন সরকারি সার্ভার আপগ্রেডের নামে ইচ্ছেকৃত ভাবে সেবা বন্ধ রাখছেন, গতি মন্থর করছেন এবং নতুন সফটওয়্যার প্রবর্তনের নামে অর্থ ও সময়ের অপচয় করছেন। বিদ্যমান সিস্টেমকে আরও উন্নত করার বদলে নতুন সফটওয়্যার তৈরির মাধ্যমে তারা নাগরিক সেবাকে আরও জটিল ও দুর্গম করে তুলছেন। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন, এনআইডি অনুবিভাগ, ভূমি ব্যবস্থাপনা, অনলাইন জিডি, আয়কর বিভাগ ইত্যাদি প্রায় সকল প্রয়োজনীয় অনলাইন সেবা প্রদাণ প্লাটফর্মের সার্ভার মাসের বিশ দিনই থাকে না।

৮. উপদেষ্টা পরিষদের সংস্কারে সমাধান না পাওয়া:

বর্তমান অন্তরবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিতই করতে পারছেন আসলে সমস্যাগুলো কোথায়। অথবা কি সমাধান করতে হবে? প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস হয়তো আমলাদের কূটকৌশল বুঝতে বা অনুধাবন করতে পারছেন না, ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র দিন দিন আরও অকার্যকর হয়ে পড়ছে। আমলারা তাদের কূটচাল, স্বেচ্ছাচারীতা ও অদক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এর মাধ্যমে সরকারকে ইচ্ছাকৃতভাবে বেকায়দায় ফেলছেন এবং সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রতিনিয়ত জনগনের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছেন।

৯. জনমনে আতঙ্ক ও সরকারের প্রতি অবিশ্বাস:

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, হয়রানি ও অদক্ষ পরিষেবা প্রদান এর কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের এর প্রতি তীব্র অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে। মানুষ মনে করছে, যে রাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেই ভেঙে পড়ছে, এবং তাদের দৈনন্দিন জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

আপনারা সবগুলো ঘটনার গতিপথ মিলিয়ে দেখুন, দেখবেন সবকিছু একই দিকে ধাবিত হচ্ছে। নিশ্চিত মনে হবে চতূর্দিক থেকে চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে অকার্যকর, সরকারকে ব্যর্থ করতে ও জনগনকে উষ্কে দিতে সুকৌশলে কাজ করছে পতিত স্বৈরাচারের তৈরি আমলাতন্ত্র।

কিন্তু সচেতন ও চিন্তাশীল নাগরিকেরা দূর থেকে সকল অসঙ্গতিগুলো ঠিকভাবেই চিহ্নিত করতে পারে। সচেতন নাগরিকদের কাছে এর সমাধানের পথ থাকলেও রাষ্ট্র ও সরকার কোন কালেই সেটাকে গ্রহণ করেনি। যে কারণে বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও স্বেচ্ছাচারিতা রাষ্ট্রকে ক্রমশ অকার্যকর করে তুলছে।

আজ বাংলাদেশে নাগরিক সেবায় হয়রানি, দীর্ঘসূত্রিতা ও অদক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেশের সার্বিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে যা বলার ভাষা আমার নেই। অন্তবর্তীকালিন সরকার ও উপদেষ্টা পরিষদকে এই সমস্যাটি জরুরীভাবে সমাধান করতে জরুরি আহব্বান করছি, বর্তমানে এটিই রাষ্ট্রকে কার্যকর করতে একমাত্র পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
নতুবা এই সরকারের বৈধতা ও দ্রুতই সাধারণ জনগণ সহ সকল পক্ষের জনসমর্থন হারাতে পারে অন্তরবর্তীকালীন সরকার। সেই সাথে জনগনের সাথে প্রতারণার ট্যাগ লাগাও অস্বাভাবিক বলে মনে করছি না।

– মোঃ কাওসার আহম্মেদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *