রংপুরে দেদার রোগাক্রান্ত পশু জবাই, নিয়ম মানে না কেউ

গণমঞ্চ ডেস্ক নিউজ

রংপুর অঞ্চলে যেখানে-সেখানে রোগাক্রান্ত পশু জবাই করে মাংস বিক্রি করায় মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ছে অ্যানথ্রাক্স রোগ। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, গতকাল বুধবারও মিঠাপুকুরে চারজনের দেহে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পশু জবাইয়ের আগে পরীক্ষা করার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ফলে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গবাদি পশুর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড়, নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শে এসে প্রথমে রংপুরের পীরগাছায় এ রোগ ধরা পড়লেও দ্রুত তা বিভিন্ন উপজেলায় ছড়াচ্ছে। পীরগাছায় দুজনের মৃত্যুর খবরে ১১ নারী-পুরুষের নমুনা সংগ্রহ করে আটজনের দেহে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়। এর পর থেকে রংপুর অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মুহাম্মদ তানভীর হাসনাত জানান, অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের ৫০ জনের তথ্য আমাদের কাছে আছে, যারা চিকিৎসা নিয়েছেন। এ রোগ গবাদি পশু থেকে মানুষে ছড়ায়, তবে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না।

রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত জুলাই ও সেপ্টেম্বরে পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে দুজন মারা যান। একই সময়ে অ্যানথ্রাক্সে উপজেলার চার ইউনিয়নে অর্ধশত মানুষ আক্রান্ত হন। ওই সময় ঘটনাস্থল থেকে অসুস্থ গরুর মাংসের নমুনা পরীক্ষা করে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত করেছিল প্রাণিসম্পদ বিভাগ। পরে আইইডিসিআরের একটি প্রতিনিধি দল গত ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর পীরগাছা সদর এবং পারুল ইউনিয়নের ১১ নারী-পুরুষের নমুনা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে আটজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়। আইইডিসিআর সূত্র বলছে, ফ্রিজে রাখা গরুর মাংসে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু পাওয়া যায়।

রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. শাহীন সুলতানা বলেন, শুধু পীরগাছা নয়, কাউনিয়া ও মিঠাপুকুরেও একই ধরনের উপসর্গের রোগী পাওয়া গেছে। পরে আরও আট রোগীর নমুনা আইইসিডিআরে পাঠানো হলে গতকাল প্রতিষ্ঠানটি জানায়, এর মধ্যে চারজনের দেহে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে। তারা হলেন–সোরহাব হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, মনির হোসেন ও মজিবর রহমান।

অসুস্থ গবাদি পশু জবাই ও অসুস্থ প্রাণীর মাংস না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, রংপুর অঞ্চলে নতুন করে প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। কেন হচ্ছে, তা গবেষণার বিষয়।

অ্যানথ্রাক্স যেভাবে মানবদেহে

অ্যানথ্রাক্স সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে পীরগাছা সদর, ছাওলা ও তাম্বুলপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে। তাম্বুলপুর এলাকার জয়নাল মিয়া বলেন, ‘আমার চাচা রোগাক্রান্ত গরু জবাই করে মাংস দিয়েছিলেন। তা ধুয়ে রান্না করায় আমার স্ত্রীর হাতে ঘা হয়েছে। ওই মাংস যারাই নাড়াচাড়া করেছেন, সবাই আক্রান্ত হয়েছেন।’

পীরগাছায় শতাধিক মানুষ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়েছিলেন অসুস্থ পশুর সংস্পর্শে গিয়ে। এর মধ্যে মাংস রান্না করে অসুস্থ হওয়ায় গত ৬ সেপ্টেম্বর কমলা বেগমকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান। এর আগে গত আগস্টে রোগাক্রান্ত গরু জবাইর পর মাংস কাটতে গিয়ে এই রোগে আক্রান্ত হন পীরগাছার কৃষক আব্দুর রাজ্জাক। আক্রান্তের সাত দিন পর মারা যান তিনি।

আক্রান্তরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হলে প্রথমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চুলকায়। পরে আস্তে আস্তে ফুসকুড়ি হয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। জায়গাটি কালো হয়ে মাংস পচে যায়। ভেতরে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া করে। তাদের অভিযোগ, একের পর এক মানুষ আক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রাণিসম্পদ দপ্তরের কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এতে করে যেমন মারা যাচ্ছে গবাদি পশু, তেমনি আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে গিয়ে সংক্রমিত হচ্ছে মানুষ।

রংপুরে কেন অ্যানথ্রাক্স

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রংপুর বিভাগের আট জেলায় প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার পশু জবাই হয়। তবে এসব পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় না। বিভাগে এক হাজার ৩০৩টি হাটবাজার রয়েছে, কোথাও নেই আধুনিক কসাইখানা বা ভেটেরিনারি সার্জনের উপস্থিতি।

আইন অনুযায়ী, পশু জবাইর আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও তা মানা হচ্ছে না। ফলে রোগাক্রান্ত পশুর মাংস সরাসরি মানুষের খাদ্যচক্রে ঢুকছে। এর মধ্য দিয়ে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তা একসঙ্গে হুমকির মুখে পড়ছে। প্রচলিত আইনে মাংস ব্যবসা শুরু করার আগে প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ নিতে হয়। এর পর প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে নিতে হয় মাংস বিক্রির লাইসেন্স। রংপুর বিভাগের অধিকাংশ মাংস ব্যবসায়ীরই এ ধরনের সনদ নেই।

পীরগাছার পর এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে পাশের জেলা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে। সেখানে ৩০ থেকে ৩৫টি স্পটে দিনে গরু-ছাগল জবাই হয় ৬০ থেকে ৬৫টি। সুন্দরগঞ্জ পৌর বাজার ইজারাদার শুকুর আলী বলেন, পৌরসভায় নিয়মিত পরীক্ষা হয়। তবে অন্য জায়গায় অসুস্থ গরু জবাই করে মাংস অন্যত্র পাইকারি বিক্রি করা হয়। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. বিপ্লব কুমার দে বলেন, সুন্দরগঞ্জ পৌরসভা এবং রামগঞ্জ বাজারের কসাইখানায় দেখভাল করছি আমরা। সেখানে পরীক্ষা ছাড়া কোনোভাবেই গরু-ছাগল জবাই করতে দেওয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া বাকি কসাইখানায় চিঠি পাঠানো হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ বিভাগের ঢিলেমি

ভুক্তভোগীরা জানান, পীরগাছায় অজানা রোগে দুই মাসে শতাধিক গবাদি পশু মারা গেছে। এতে খামারিরা পড়েছেন বিপাকে। আক্রান্ত পশুর শরীরে প্রথমে জ্বর দেখা দেয়, এর পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মারা যায়। কিন্তু সময় মতো ভ্যাকসিন না দেওয়ায় গবাদি পশুর রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকে।

এ ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে গড়ে ৫০ জন করে মাংস ব্যবসায়ী আছেন। তাদের কারও লাইসেন্স নেই, এমনকি জবাইর আগে পশুর স্বাস্থ্যও পরীক্ষা করা হয় না। তারাগঞ্জের মাংস ব্যবসায়ী হাসিনুর ইসলাম বলেন, মাংস ব্যবসার জন্য প্রাণিসম্পদ থেকে লাইসেন্স নিতে হয়– এটা জানতাম না, কয়েক দিন আগে মিটিংয়ে শুনেছি। এখন লাইসেন্স নেব। তবে অসুস্থ পশু জবাই করা হয় না বলে দাবি করেন তিনি।

গঙ্গাচড়ার মাংস ব্যবসায়ী আমির আলী বলেন, মাংস বিক্রির শেড দখল করে নিয়েছে অন্যরা। তাই অন্যত্র পশু জবাই করে এখানে মাংস নিয়ে আসি। সে কারণে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার সুযোগ থাকে না।

যত্রতত্র মাংস বিক্রি

রংপুরের বড় বড় হাটবাজারে কসাইখানা ও মাংস বিক্রির নির্ধারিত শেড থাকলেও তা কাজে আসছে না। মাংস ব্যবসায়ীরা বাইরে পশু জবাই করে এখানে মাংস এনে বিক্রি করেন। এ ছাড়া হাটবাজার ছাড়াও রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাংসের দোকান হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তা নজরে আসে না। রংপুর জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর মাহবুবার রহমান বলেন, উপজেলাগুলোতে স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা তদারকি করেন। তবে যেখানে-সেখানে পশু জবাই ও মাংস বিক্রি করায় তদারকি কষ্টসাধ্য। সেই সুযোগে মাংস ব্যবসায়ীরা রোগাক্রান্ত পশু জবাই করেন।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবু ছাইদ বলেন, রংপুরে ১৩ লাখের বেশি গরু, ছাগল ও ভেড়া রয়েছে। গত ২৬ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত এক লাখ ৬৫ হাজার গবাদি পশুকে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধী টিকা দেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে মসজিদ, মন্দির, হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সব মাংস ব্যবসায়ীকে লাইসেন্স ও পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য বলা হয়েছে। এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে। বৈধভাবে মাংস ব্যবসা না করলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

প্রাণিসম্পদ দপ্তরের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ডা. আব্দুর হাই সরকার বলেন, আমরা নিয়মিত পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে চাই। তবে জনবল সংকটের কারণে প্রতিটি হাটে চিকিৎসক পাঠানো সম্ভব হয় না। তার পরও স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে হাটবাজারে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার চেষ্টা করছি।

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *