মোদির চীন সফর নিয়ে বিরোধী দলগুলোর কঠোর সমালোচনা

গণমঞ্চ নিউজ ডেস্ক –

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চীন সফরকে সমালোচনাবিদ্ধ করে ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস জানাল, তিয়ানজিনে চীনা ড্রাগনের কাছে ভারতীয় হাতি আত্মসমর্পণ করেছে। কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ ‘এক্স’ হ্যান্ডলে এই অভিযোগ করে আজ সোমবার বলেছেন, স্বঘোষিত ৫৬ ইঞ্চি ছাতির স্বরূপ তিয়ানজিনে পুরোপুরি উন্মোচিত হয়ে গেল।

একই রকম সমালোচনায় মুখর হায়দরাবাদের এআইএমআইএম। সেই দলের নেতা ও লোকসভা সদস্য আসাউদ্দিন ওয়েইসি বলেছেন, এত দিন ধরে ভারতবাসী যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে আসছিল, এই সফরে সেগুলোর একটি জবাবও প্রধানমন্ত্রী মোদি দিতে পারেননি। তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।

জয়রাম রমেশ সোমবার সকালে ‘এক্স’ মারফত বলেন, বহু দিন ধরেই সন্ত্রাসবাদ নিয়ে চীনের দ্বিমুখী নীতি ও দ্বিচারিতার অভিযোগ ভারত করে আসছে। অথচ দেখা গেল, এসসিও সম্মেলনে চীনা প্রেসিডেন্ট সিকে প্রধানমন্ত্রী মোদি বললেন, ভারত ও চীন দুই দেশই সন্ত্রাসবাদের শিকার।

এই মন্তব্যের পরই কংগ্রেস নেতা জয়রামের প্রশ্ন, এটা যদি তথাকথিত ড্রাগনের কাছে তথাকথিত হাতির আত্মসমর্পণ না হয়, তাহলে একে কী বলা যাবে?

এই সফরে মোদির ভূমিকাকে ‘দেশবিরোধী’ বলতেও কংগ্রেস ছাড়েনি। জয়রাম লিখেছেন, ‘অপারেশন সিঁদুরের’ সময় পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের যুগলবন্দী নিয়ে ভারতীয় সেনা কর্তারা সরব হলেও সির সঙ্গে আলোচনায় মোদি তার ধারকাছ দিয়েও হাঁটলেন না। পুরোপুরি চুপ করে থাকলেন। এটা আরও বড় দেশদ্রোহিতা।

জয়রামের কথায়, স্বঘোষিত ৫৬ ইঞ্চির ছাতির নেতা এই সফরে নিজেকে পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিলেন। ২০২০ সালের ১৯ জুন (গালওয়ান সংঘর্ষ) চীনকে ক্লিন চিট দিয়ে দেশের স্বার্থের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন মোদি। এবার ২০২৫ সালের ৩১ আগস্ট দিনটিও তিয়ানজিনে কাপুরুষোচিতভাবে নতজানু হওয়ার কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

মোদির সমালোচনায় একই রকম সরব আসাউদ্দিন ওয়েইসি। গতকাল রোববার রাতেই তিনি ‘এক্স’ মারফত তাঁর ক্ষোভের কথা প্রকাশ করেন। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর উত্তরে নির্বাক থাকার অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘অপারেশন সিঁদুরের’ সময় পাকিস্তানকে চীনের সমর্থন দেওয়া নিয়ে একটি শব্দও নরেন্দ্র মোদি উচ্চারণ করেননি। চীন–পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর আফগানিস্তান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গেও তিনি নীরব থেকেছেন।

ওয়েইসি বলেন, অভিন্ন নদীগুলোর জলপ্রবাহ–সম্পর্কিত তথ্য দেওয়া নিয়েও কোনো কথা শোনা যায়নি। সীমান্ত পরিস্থিতি এমন যে এখনো ভারতীয় সেনারা লাদাখের বাফার জোনে টহল দিতে পারেন না। ২০২০ সালের পর ভারতীয় মেষপালকদেরও বহু চারণভূমিতে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। বিরল খনিজ পদার্থসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের রপ্তানি শুরু করা নিয়েও চীন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এ কথাও বলেনি, ভারত থেকে তারা বেশি পণ্য আমদানি করবে।

সফর নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে ওয়েইসি লিখেছেন, ছবি তোলা, জ্যাকেটের রং অথবা কার্পেটের দৈর্ঘ্য নয়, এসব বিষয়ই ভারতীয়দের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখের কথা, এসব বিষয় নিয়ে কিছুই হলো না। মোদি–সি বৈঠক ব্যর্থ হলো।

বস্তুত, মোদির চীন সফর শুরুর আগেই রোববার জয়রাম ‘এক্স’ মারফত জানিয়েছিলেন, কোন কোন বিষয়ে চীনের সঙ্গে অর্থবহ আলোচনা দেখতে কংগ্রেস আগ্রহী। সেগুলোর মধ্যে যেমন পূর্ব লাদাখে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা ছিল, তেমনই ছিল চীনা পণ্যের অবাধ আমদানির ফলে ভারতীয় মাঝারি ও ক্ষুদ্রশিল্পের ধ্বংস হওয়ার বিষয়।

জয়রাম রোববারের ‘এক্স’ বার্তায় বলেছিলেন, অন্যান্য দেশ যখন চীনা পণ্যের অবাধ প্রবেশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে, তখন ভারত সরকার তাদের অবাধ প্রবেশ মেনে নিয়েছে। ভারত–চীন সম্পর্কের এই নতুন স্বাভাবিকতার সংজ্ঞা কি তাহলে চীনের দাপট ও আগ্রাসন এবং ভারতের মেরুদণ্ডহীনতা ও নতিস্বীকার? এই প্রশ্ন জয়রাম তুলেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ভারত বুঝিয়ে দিচ্ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্টের চাপের কাছে তারা মাথা নোয়াবে না। পাল্টা হিসেবে ভারত, চীন ও রাশিয়া যে এক নতুন অক্ষ তৈরি করতে চলেছে, সেই বার্তাও নানাভাবে দেওয়া হচ্ছিল। তিয়ানজিনে এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নরেন্দ্র মোদি তখনই নেন। চীনও বুঝিয়ে দেয়, যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্য না কিনলেও তারা নেবে।

পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী মোদিসহ অন্যান্য ভারতীয় নেতা স্বনির্ভরতার ওপর জোর দিতে থাকেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘও (আরএসএস) বিদেশি পণ্য বর্জন করে স্বদেশি পণ্য কেনার আহ্বান জানায়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বারবার স্বদেশিয়ানায় জোর দিয়েছেন। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, মার্কিন বাজার বন্ধ হলে আরও বেশি চীনা পণ্য ভারতে ঢুকবে।
২০২৪–২৫ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, চীন–ভারতের মধ্যে মোট বাণিজ্য হয়েছে ১১৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চীন থেকে ভারত আমদানি করেছে ১০ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের সমতুল্য পণ্য। অথচ চীনে রপ্তানি করেছে মাত্র ৯৮০ কোটি ডলারের পণ্য। বাণিজ্যঘাটতির পরিমাণ ৯ হাজার ৯২০ কোটি ডলার।

বিভিন্ন বণিক মহলের শঙ্কা, এই প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্যঘাটতি আগামী দিনে আরও বেড়ে যাবে। এতে চীনের যেমন লাভ, তেমনই ভারতের চীন নির্ভরতা আরও মারাত্মক হয়ে উঠবে।

টেলিকম, ইলেকট্রনিকস ও শক্তি বা এনার্জি ক্ষেত্রে চীনের প্রতি অতি নির্ভরতা ভারতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি থাকবে চীনের অনুকূলে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ যদি ভারতের ‘সর্বনাশ’ হয়, চীনের ক্ষেত্রে তা হবে ‘পৌষ মাস’।

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *