মাওলানা শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে
ইসলামের মূল ভিত্তি হলো ঈমান বা বিশ্বাস। এই বিশ্বাস কেবল মুখের স্বীকৃতি নয়, বরং তা অন্তরের গভীরে প্রোথিত এক দৃঢ় অঙ্গীকার, যা মুমিনের প্রতিটি কর্মে প্রতিফলিত হয়। মুমিন হলো সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহ, তাঁর রাসূল, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব, কিয়ামত দিবস এবং তাকদীরের ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে। তবে এই বিশ্বাসকে বাস্তব জীবনে ফুটিয়ে তোলার জন্য কিছু বিশেষ গুণাবলীর প্রয়োজন হয়, যা কোরআন ও হাদিসে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই গুণাবলীগুলো একজন ব্যক্তিকে শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। এই প্রতিবেদনে আমরা কোরআন ও হাদিসের আলোকে মুমিনের সেইসব গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলী নিয়ে আলোচনা করব, যা তাদেরকে ইহকাল ও পরকালে সফল করে তোলে।
১. বিনয় ও একাগ্রতার সাথে সালাত আদায়
২. অনর্থক ও বাজে কাজ থেকে বিরত থাকা
একজন মুমিনের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হলো সালাত। মুমিনরা সালাতকে কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে দেখে না, বরং আল্লাহর সাথে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করে। তারা সালাতে সর্বোচ্চ বিনয়, একাগ্রতা ও মনোযোগ বজায় রাখে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা সফল মুমিনদের প্রথম গুণ হিসেবে সালাতে বিনয়ী হওয়ার কথা বলেছেন:”নিশ্চয়ই মুমিনরা সফলকাম হয়ে গিয়েছে, যারা তাদের সালাতে বিনয়ী।” (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত: ১-২)সালাতের এই বিনয় তাদের হৃদয়ে শান্তি এনে দেয় এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও আল্লাহর প্রতি তাদের আনুগত্যকে দৃঢ় করে।
মুমিনের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। তাই তারা এমন কোনো কাজ বা কথায় সময় নষ্ট করে না, যা তাদের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। তারা সবসময় ইতিবাচক ও অর্থবহ কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:”এবং যারা অনর্থক বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত: ৩)মুমিনরা জানে, প্রতিটি কাজের জন্য তাদের আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে, তাই তারা সময়কে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করে।
৩. যাকাত আদায় ও আর্থিক স্বচ্ছতা
মুমিনের জীবন শুধু ব্যক্তিগত ইবাদতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সামাজিক দায়বদ্ধতারও প্রতিফলন। তারা নিজেদের সম্পদের মধ্যে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের হক স্বীকার করে এবং নিয়মিত যাকাত আদায় করে। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে তারা নিজেদের অন্তরকে লোভ ও কৃপণতা থেকে পবিত্র করে এবং সমাজে আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখে। কোরআনে সফল মুমিনদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন:”এবং যারা যাকাত আদায়কারী।” (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত: ৪)
৪. লজ্জাস্থানের হেফাজত
একজন মুমিন তার চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষায় অত্যন্ত সতর্ক থাকে। তারা তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, যা তাদের ঈমান ও তাকওয়ার পরিচায়ক। এই গুণের মাধ্যমে তারা সমাজের নৈতিক অবক্ষয় থেকে নিজেদের রক্ষা করে এবং একটি পবিত্র সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে। কোরআনে বলা হয়েছে:”এবং যারা তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, তাদের স্ত্রী ও অধিকারভুক্ত দাসীগণ ছাড়া, এতে তারা তিরস্কৃত হবে না।” (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত: ৫-৬)
৫. আমানত রক্ষা ও অঙ্গীকার
পূরণআমানত রক্ষা এবং ওয়াদা পালন করা মুমিনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ। এই গুণটি তাদের মধ্যে বিশ্বাস ও নির্ভরযোগ্যতা তৈরি করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব হোক বা মানুষের সাথে করা কোনো ওয়াদা, মুমিনরা তা পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:”এবং যারা তাদের আমানত ও অঙ্গীকার রক্ষা করে।” (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত: ৮)রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যার মধ্যে আমানতদারি নেই, তার ঈমান নেই। আর যার মধ্যে অঙ্গীকার পূরণের প্রবণতা নেই, তার দ্বীন নেই।” (মুসনাদে আহমাদ)
৬. ধৈর্য ও দৃঢ়তামুমিনের জীবনে বিপদ-আপদ,
দুঃখ-কষ্ট আসা স্বাভাবিক। তবে তারা এসব পরিস্থিতিতে হতাশ না হয়ে আল্লাহর উপর ভরসা রাখে এবং ধৈর্য ধারণ করে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, আল্লাহ তাদের সাথে আছেন এবং প্রতিটি কষ্টের পর স্বস্তি আসবে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:”হে ঈমানদারগণ, তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।” (সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ১৫৩)রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “মুমিনের অবস্থা বড়ই আশ্চর্যজনক। তার সব কিছুতেই কল্যাণ রয়েছে। যদি সে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, তবে সে শুকরিয়া আদায় করে, আর তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি সে দুঃখ-কষ্টে থাকে, তবে সে ধৈর্য ধারণ করে, আর তাও তার জন্য কল্যাণকর হয়।” (সহীহ মুসলিম)
৭. ক্ষমা ও সহনশীলতা
মুমিনরা ক্ষমাশীল ও সহনশীল হয়। তারা ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও প্রতিশোধের পরিবর্তে ক্ষমা ও ভালোবাসার পথ বেছে নেয়। এই গুণটি তাদের অন্তরকে কলুষমুক্ত রাখে এবং সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন ক্ষমা ও সহনশীলতার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত।
৮. সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ
মুমিনের দায়িত্ব শুধু নিজের জীবনকে পরিশুদ্ধ করা নয়, বরং সমাজকে পরিশুদ্ধ করার জন্যও কাজ করা। তারা মানুষকে সৎ কাজের দিকে আহ্বান জানায় এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:”আর মুমিন নর ও মুমিন নারী একে অপরের সহযোগী। তারা সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে।” (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৭১)
কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত মুমিনের এই গুণাবলীগুলো একটি সামগ্রিক জীবনব্যবস্থার অংশ। এই গুণগুলো ধারণ করে একজন মানুষ তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে পারে। প্রতিটি মুমিনের উচিত এই গুণগুলো অর্জনের জন্য সচেষ্ট হওয়া, যাতে তারা ইহকালে সফল এবং পরকালে জান্নাতের অধিকারী হতে পারে। মুমিনের প্রকৃত সফলতা নিহিত রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মধ্যে, আর এই গুণাবলী হলো সেই পথে চলার পাথেয়।