মহাবিশ্বের প্রসারণ : কোরআনের ইঙ্গিত ও আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার

মাওঃ শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে

মহাবিশ্বকে ঘিরে মানুষের কৌতূহল আজকের নয়। সহস্র বছর ধরে মানুষ আকাশের তারা, চাঁদ ও গ্রহের দিকে তাকিয়ে ভেবেছে—এই মহাবিশ্বের শুরু কোথা থেকে? এর পরিসর কতটুকু? আর এর গন্তব্য কোথায়? আধুনিক বিজ্ঞান দীর্ঘ গবেষণার পর আজ স্বীকার করছে যে মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। আশ্চর্যজনকভাবে, চৌদ্দশো বছর আগে কোরআন মাজীদেই এ প্রসারণের ইঙ্গিত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রিপোর্টে আমরা কোরআন ও হাদিসের দলীল, আধুনিক বিজ্ঞানীদের গবেষণা এবং ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি মিলিয়ে মহাবিশ্বের প্রসারণ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

কোরআনের ইঙ্গিত আল্লাহ তা’আলা সূরা আয-যারিয়াতের ৪৭ নম্বর আয়াতে বলেনঃ وَالسَّمَاءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْيٍد وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ “আমি আকাশকে আমার শক্তি দ্বারা সৃষ্টি করেছি এবং নিশ্চয়ই আমি এটিকে সম্প্রসারণকারী।” (সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত ৪৭)

এই আয়াত স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে আকাশ বা মহাবিশ্ব স্থির নয়, বরং এটি ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে। তাফসীরকারগণ এখানে “لَمُوسِعُونَ” শব্দের অর্থ করেছেন: আমরা সম্প্রসারণকারী, বা বৃদ্ধি করে চলেছি। অর্থাৎ, কোরআন যে সময়ে অবতীর্ণ হয়েছিল, তখনকার মানুষ জানতেই পারেনি যে মহাবিশ্ব স্থির নয়। অথচ আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কয়েকশ বছর পর এসে একই সত্য আবিষ্কার করেন।

আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার

১. এডউইন হাবলের পর্যবেক্ষণ (১৯২৯)

আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল তার টেলিস্কোপ দ্বারা পর্যবেক্ষণ করে দেখেন যে দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর মানে হলো মহাবিশ্বের প্রতিটি অংশ একে অপর থেকে দূরে যাচ্ছে—অর্থাৎ মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। এ আবিষ্কারকে বলা হয় “হাবল’স ল” (Hubble’s Law)।

২. বিগ ব্যাং তত্ত্ব

বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে মহাবিশ্ব একটি অতি ক্ষুদ্র, অসীম ঘনবস্তুর বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্টি হয়। এরপর থেকেই এটি ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকে। এ ধারণাই বিগ ব্যাং থিওরি নামে পরিচিত। আশ্চর্যজনকভাবে, এই ধারণার সাথেও কোরআনের বর্ণনা মিলে যায়।

আল্লাহ বলেনঃ أَوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا

“কাফেররা কি লক্ষ্য করে না যে আসমান ও জমিন একত্রিত ছিল, তারপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম?” (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ৩০) এই আয়াতের “একত্রিত থাকা” ও “পৃথক করা” অংশটি আধুনিক বিগ ব্যাং তত্ত্বের সাথে আশ্চর্যজনকভাবে সঙ্গতিপূর্ণ।

৩. কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (১৯৬৫)

আরনো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন নামক দুই বিজ্ঞানী মহাবিশ্বে একধরনের মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ আবিষ্কার করেন, যা বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের অবশিষ্ট তাপ হিসেবে বিবেচিত। এই প্রমাণ মহাবিশ্বের প্রসারণ তত্ত্বকে আরো শক্তিশালী করে।

ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের দৃষ্টিতে মহাবিশ্বের প্রসারণ কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয়। কারণ, আল্লাহ তাআলা নিজেই কোরআনে এর ইঙ্গিত দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে: রাসূলুল্লাহ ﷺ এক দোয়ায় বলতেনঃ اللَّهُمَّ رَبَّ السَّمَاوَاتِ وَرَبَّ الْأَرْضِ وَرَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ “হে আল্লাহ! আপনি আসমানসমূহের রব, যমীনের রব এবং মহান আরশের রব।” (সহিহ মুসলিম) এ থেকে বোঝা যায়, আকাশসমূহ ও আরশ মহান আল্লাহর সৃষ্টির অংশ, যা তাঁর নিয়ন্ত্রণেই প্রসারিত হচ্ছে।

বিজ্ঞানীদের মন্তব্য

স্টিফেন হকিং তার গ্রন্থ A Brief History of Time-এ উল্লেখ করেছেন যে মহাবিশ্বের প্রসারণ একটি অস্বীকারযোগ্য বাস্তবতা। তিনি বলেন, “আমরা যত দূরে তাকাই, গ্যালাক্সিগুলো আমাদের থেকে তত দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে।” কার্ল সাগানও বলেন, “মহাবিশ্ব হলো একটি অবিরাম প্রসারিত কসমস। আমরা আজ যে তারা দেখি, তা লাখো বছর আগের আলোর প্রতিফলন।”

মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ প্রসারণ

বিজ্ঞানীরা ধারণা দেন, মহাবিশ্বের প্রসারণ তিনভাবে শেষ হতে পারে— বিগ ক্রাঞ্চ: একসময় মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত হয়ে আবার একটি বিন্দুতে ফিরে আসবে। হিট ডেথ: মহাবিশ্ব এত প্রসারিত হবে যে সবকিছু শূন্যতার দিকে ঠেলে যাবে। বিগ রিপ: প্রসারণ এত দ্রুত হবে যে গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, এমনকি অণু পর্যন্ত ছিঁড়ে যাবে।

কোরআনে আল্লাহ বলেনঃ

 يَوْمَ نَطْوِي السَّمَاءَ كَطَيِّ السِّجِلِّ لِلْكُتُبِ “যেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে নেব, যেমন লেখা গুটিয়ে নেয়া হয়।” (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ১০৪) অর্থাৎ, ইসলামের দৃষ্টিতে মহাবিশ্বের প্রসারণ একদিন থেমে যাবে এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুনরায় সঙ্কুচিত হবে।

মহাবিশ্বের প্রসারণ কেবল আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার নয়, বরং এটি আল্লাহর কিতাব কোরআনে চৌদ্দশো বছর আগে ঘোষিত একটি চিরন্তন সত্য। হাবল ও আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে যা প্রমাণ করেছেন, কোরআন সেই সত্য পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছে।

আজ আমাদের মনে করিয়ে দেয় আল্লাহর কিতাব কোরআন কেবল আধ্যাত্মিক নয়, বরং এতে রয়েছে বৈজ্ঞানিক অলৌকিকতার অসংখ্য নিদর্শন। মহাবিশ্বের প্রসারণ এর একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *