ভারতকে শুল্কের মাধ্যমে যেভাবে চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

গণমঞ্চ নিউজ ডেস্ক –

আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য আলোচনায় ফের বসার আগেই ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যদি ভারত যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত ভুট্টা কিনতে অস্বীকৃতি জানায় তবে তারা মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার হারাতে পারে। 

অ্যাক্সিওসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লুটনিক সতর্ক করেন, শুল্ক না কমালে ভারতকে ‘কঠিন সময়ের’ মুখে পড়তে হবে। যদিও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে ভারতের প্রতি চাপ কিছুটা হ্রাস করছেন, তবুও লুটনিক অভিযোগ তুলেছেন যে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক একতরফা।

লুটনিক অভিযোগ করে বলেন, ‘ভারত আমাদের কাছে পণ্য বিক্রি করে এবং আমাদের সুযোগ সুবিধা নেয়। অপরদিকে তারা তাদের অর্থনীতি থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রাখে, অথচ আমাদের কাছে তারা অবাধে পণ্য বিক্রি করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভারত গর্ব করে বলে তাদের ১৪০ কোটি মানুষ আছে। তাহলে কেন সেই ১৪০ কোটি মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের এক বুশেল ভুট্টাও কিনবে না? তারা আমাদের কাছে সবকিছু বিক্রি করে, অথচ আমাদের ভুট্টা কিনতে চায় না। তারা সব কিছুর ওপর শুল্ক আরোপ করে।’

(এক বুশেল হলো শুকনো দ্রব্যের জন্য ব্যবহৃত একটি ধারণক্ষমতার পরিমাপ, যা প্রায় ৩৫ দশমিক ২ লিটার পরিমাণের সমান।)

লুটনিক দাবি করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতকে বলেছেন ‘শুল্ক কমাও। তা না হলে, আমাদের যেভাবে ব্যবহার করছো আমরাও তোমাকে সেভাবে ব্যবহার করব।’ তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনকে বছরের পর বছর ধরে চলা এ অন্যায় সংশোধন করতে হবে, ‘তাই আমরা পাল্‌টা শুল্ক চাই যতক্ষণ না এটি সমাধান হয়।’

তার ভাষায়, ‘এটাই প্রেসিডেন্টের মডেল। তুমি হয় এটি মেনে নাও, নয়তো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তা বাজারের সঙ্গে ব্যবসা করতে গিয়ে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে।’

ভারত কেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভুট্টা আমদানি করে না

যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত ভুট্টার বেশিরভাগই জেনেটিকভাবে পরিবর্তিত (জিএম) ফসল। কিন্তু ভারত জিএম ভুট্টা ব্যবহার করে না। জেনেটিকভাবে পরিবর্তিত ভুট্টার জাত যাতে মাটির মাধ্যমে বা পশুর খাদ্যের মাধ্যমে খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য আমদানি বা স্থানীয় কৃষকের মাধ্যমে চাষ—দুটোই ভারতে নিষিদ্ধ।

এ কারণেই ইথানল উৎপাদনের জন্য জিএম ভুট্টা চাষের প্রস্তাবটি এনআইটিআই আয়োগও বাতিল করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভুট্টার জাতগুলো জেনেটিকভাবে পরিবর্তিত হওয়ায় এটি বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা ভুট্টার মধ্যে একটি। এটি শুধু মানুষের খাদ্য হিসেবেই নয়, সরাসরি পশুখাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

ভারতের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক

মাসের পর মাস ধরে ট্রাম্প দাবি করেছিলেন যে দুই দেশের মধ্যে শিগগিরই বাণিজ্য চুক্তি হতে চলেছে। কিন্তু চুক্তি করার পরিবর্তে তিনি ভারতীয় আমদানির ওপর শুল্ক দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করে দেন। এতে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদসহ, সম্পর্কটি দৃঢ় হয়েছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে রুশ তেল কেনায় দিল্লির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক—যা বিশ্বের যেকোনো দেশের ওপর আরোপিত সর্বোচ্চ শুল্কগুলোর একটি।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ট্রাম্প ও তার শীর্ষ কর্মকর্তারা রাশিয়া থেকে তেল কেনার জন্য ভারতের সমালোচনা করছেন এবং অভিযোগ করছেন যে ভারত ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থায়ন করছে। তবে নয়াদিল্লি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

মার্কিন পদক্ষেপকে ভারত বর্ণনা করেছে ‘অন্যায়, অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে। রুশ অপরিশোধিত তেল কেনার পক্ষে সাফাই গেয়ে ভারত বলেছে, তাদের জ্বালানি সংগ্রহ সম্পূর্ণভাবে জাতীয় স্বার্থ ও বাজার পরিস্থিতি দ্বারা পরিচালিত।

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তি

সপ্তাহব্যাপী কূটনৈতিক উত্তেজনার পর গত সপ্তাহে ট্রাম্প বলেন, তার প্রশাসন এখনও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা নিরসনে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তিনি শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা বলবেন। যা দুই দেশের সম্পর্কে শীতলতা কাটার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ট্রাম্প সুর নরম করে বলেন, তিনি আসন্ন কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মোদির সঙ্গে কথা বলার অপেক্ষায় আছেন এবং একটি বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সদাচরণে ইতিবাচক সাড়া দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। উভয় নেতা শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

এরপর জানা যায়, চলতি সপ্তাহের শেষ দিকে আরও আলোচনার জন্য মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিরা নয়াদিল্লি সফরে যাচ্ছেন। তবে আলোচনায় বসার আগেই নতুন শর্ত আরোপ করেন মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক।

ভুট্টা বাণিজ্যে চাপের কারণ

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন কৃষকরা এ বছর ব্যাপক সংকটে পড়েছেন, যার প্রধান কারণ চীনের সঙ্গে চলমান অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব।

এপ্রিল থেকে বেইজিং ও ওয়াশিংটন বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, ফলে আমেরিকান কৃষিপণ্যের জন্য চীনের অর্ডার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এর ফলে অনেক মার্কিন কৃষক দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করেছেন, যা জুলাইয়ে ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনা চলছে, তবে আলোচকরা নাজুক যুদ্ধবিরতি বজায় রাখা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের অধিকার, শুল্ক ও বিরল খনিজ রপ্তানি নিয়ে বিরোধ সমাধানের মতো বড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন।

বেইজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন কৃষকদের জন্য নতুন বাজার তৈরির চেষ্টা করছে। ট্রাম্পের অন্যতম বড় ভোটভিত্তি এই কৃষকরা, আর সেই নতুন বাজার হিসেবে ভারতকে দেখছে ওয়াশিংটন।

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *