মিয়া সুলেমান, ময়মনসিংহ থেকে
সত্তরের কোঠায় পৌঁছে যাওয়া দুই বোন। বয়স তাঁদের কাঁধে ভর করেছে, কিন্তু মন এখনও তরুণ। বাবার অসমাপ্ত স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে তাঁরা নেমে পড়েছেন এক অসম যুদ্ধের ময়দানে। ফলাফল—অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া এক গ্রামের স্কুল আবার আলোয় ফিরেছে। এই স্কুলের নাম রোকনপুর জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এই বিদ্যালয়টির ইতিহাস যেমন দীর্ঘ, তেমনি এর টিকে থাকার লড়াইও রুদ্ধশ্বাস নাটকের মতো।
অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান। তিন দশকেরও বেশি সময় দেশের উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেও তাঁর মন পড়ে থাকত গ্রামের মানুষের দিকে। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার আলো যদি গ্রামগঞ্জে না পৌঁছে, তবে জাতির সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই বিশ্বাস থেকেই ১৯৯৫ সালে তিনি নিজ গ্রামের বঞ্চিত শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন রোকনপুর জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়।
ড. আজিজের বাবা-মা মিয়া বখশ ও ফরমুজেন্নেসা ১৮৯০ সালে এই গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা পরবর্তীতে রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়। সেই বিদ্যালয়ের জমি ১৯৪৪ সালে ওয়াকফ এস্টেট হিসেবে নিবন্ধিত হয়। অর্থাৎ শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্নটি ছিল তাঁদের পরিবারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
প্রতিষ্ঠার পর পনেরো বছর ব্যক্তিগত অর্থায়নে চলে বিদ্যালয়। একসময় শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত সেখানে। কিন্তু ২০১১ সালে ড. আজিজ অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সুযোগ নেয়। বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যায়, ভবনটি খড়ের গুদামে পরিণত হয়। শতাধিক শিশু পড়াশোনার সুযোগ হারায়, অভিভাবকেরা হতাশ হয়ে সন্তানদের দূরের স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হন।
ড. আজিজ মৃত্যুর আগে কন্যা ড. সুলতানা আফরোজকে বলেছিলেন—“স্কুলটা আবার শুরু করো, এটিই আমার শেষ ইচ্ছে।” সেই কথাই জীবনের দিশা হয়ে ওঠে তাঁর কাছে।
২০১৭ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে দীর্ঘ শিক্ষাজীবন ও শিক্ষকতা শেষে গ্রামে ফিরে আসেন। ব্যক্তিগত পেনশনের অর্থ ব্যয় করে বোনকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে শুরু করেন বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। ছয়জন শিক্ষক ও একজন কর্মচারী নিয়ে শুরু হয় এই দ্বিতীয় যাত্রা। প্রথম দিকে স্বেচ্ছাশ্রম ও স্বল্প বেতনে শিক্ষকেরা কাজ করলেও অনিশ্চয়তা ছিল সর্বত্র। তবে ধীরে ধীরে অগ্রগতি আসে—
*২০১৮ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পাঠদানের অনুমতি (প্রধান অনুমতি) মেলে।
*২০২৩ সালে ময়মনসিংহ বোর্ড থেকে একাডেমিক লাইসেন্স পাওয়া যায়।
*২০২৪ সালে বিদ্যালয় পায় এমপিও স্বীকৃতি।
*২০২৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর যোগ দেন এনটিআরসিএ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত পাঁচজন নতুন শিক্ষক।
এমপিওর নিয়ম অনুযায়ী, এনটিআরসিএ সনদবিহীন তিনজন শিক্ষক তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। ২০১৭ সালে বিদ্যালয়ের সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত দুইজন সনদধারী শিক্ষকও একটি সরকারি পরিপত্রের কারণে বাদ পড়েছেন।
ড. আফরোজ বহুবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে আবেদন করেছেন—“যারা যোগ্য ও সনদপ্রাপ্ত, তাঁদের যেন বঞ্চিত না করা হয়। নয় বছর ধরে যারা বিদ্যালয়ের জন্য কাজ করছেন, তাঁদের প্রতিও ন্যায্যতা প্রদর্শন করা হোক।”
প্রশাসনিক জটিলতার বাইরে দুই বোনকে লড়তে হয়েছে সামাজিক বাধার সঙ্গেও। কেউ কেউ তাঁদের উদ্যোগকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে কটাক্ষ করেছেন, ওয়াকফ এস্টেটের সদস্যদের বিরূপ মন্তব্যও সইতে হয়েছে। তবুও আফরোজ দৃঢ় কণ্ঠে বলেন—
“আমার বাবা শিক্ষার আলোয় বিশ্বাস করতেন। আমি তাঁর কন্যা, তাই এই দায়িত্ব আমার।”
বর্তমানে বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষক, নতুন ভবন ও শতাধিক শিক্ষার্থী। রয়েছে সুপরিসর শ্রেণিকক্ষ, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, টিফিন কক্ষ, নামাজের স্থান, আইসোলেশন কক্ষ এবং একটি মিলনায়তন। সেখানে নিয়মিত বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও সমকালীন বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রবেশপথে রয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্নার।
এছাড়া, বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি পাঠাগার—যা স্থানীয়দের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ফলে ঈশ্বরগঞ্জ ও নান্দাইল উপজেলার সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া কমেছে। এখন আর কিলোমিটার দূরের কুমারুলী উচ্চবিদ্যালয়ে যেতে হয় না। একজন অভিভাবক বললেন—“আমাদের সন্তানদের জন্য কাছেই ভালো মানের স্কুল পেলাম। এটা শুধু ড. আফরোজ আপার কারণে সম্ভব হয়েছে।”
এখন বিদ্যালয়ের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষক সংকট ও এমপিওর জটিলতা। তবে স্থানীয়দের বিশ্বাস, সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় এর সমাধান হবে। ড. আফরোজের স্বপ্ন স্পষ্ট—
“আমাদের সংগ্রাম থামবে না। এই স্কুলকে টেকসই, মানসম্মত ও আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এটাই হবে আমাদের প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার।”
সাংবাদিক মিয়া সুলেমান মনে করেন, রোকনপুর জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ের গল্প কেবল একটি বিদ্যালয় পুনর্গঠনের কাহিনি নয়—এটি দুই বোনের সাহসিকতা, দায়িত্ববোধ ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রতীক। ঈশ্বরগঞ্জবাসীর বিশ্বাস, তাঁদের এই সংগ্রাম আগামী প্রজন্মকে শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নের পথে অনুপ্রাণিত করবে। আজ গ্রামের মানুষ গর্ব করে বলছে—
“তাদের সন্তানদের শিক্ষার আলো নিভে যায়নি, আবার জ্বলে উঠেছে।”