গণমঞ্চ ডেস্ক নিউজ
মানুষের শরীরের প্রধান চালিকাশক্তি হলো অক্সিজেন। অক্সিজেন ছাড়া শরীরের কোষ এক মুহূর্তও বাঁচতে পারে না। আর এই অক্সিজেনকে আমাদের রক্তে প্রবাহিত করে ফুসফুস। ফুসফুস যত ভালোভাবে কাজ করবে, শরীর তত বেশি শক্তি পাবে। কিন্তু আধুনিক জীবনে আমরা এমনভাবে বসে থাকি, অস্বাস্থ্যকর খাবার খাই এবং দূষণের মধ্যে শ্বাস নিই যে আমাদের ফুসফুস দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, হাঁপানি বা কাশি বেড়ে যায়, ক্লান্তি আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। তাই ফুসফুসকে শক্তিশালী রাখতে এবং ফুসফুসে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে নিয়মিত ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই।
অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, শুধু দৌড়ানো বা জিমে ভার তোলাই ব্যায়াম। কিন্তু আসলে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণকারী বিশেষ কিছু ব্যায়াম আছে যেগুলো সরাসরি ফুসফুসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ায়। যেমন, প্রাচীন যোগব্যায়ামে প্রণায়াম নামক অনুশীলন ফুসফুসের জন্য অসাধারণ। গভীর শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার মাধ্যমে ফুসফুসে বাতাস প্রবেশ করে ভেতরের জমে থাকা দূষিত বাতাস বের হয়ে আসে। এতে অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা অনেক বাড়ে। যারা প্রতিদিন ভোরে কিছুক্ষণ প্রণায়াম করেন তারা সহজেই বুঝতে পারেন তাদের শরীর সারাদিন সতেজ থাকে, মাথায় স্বচ্ছতা থাকে, এবং কাজ করার উদ্যম বেড়ে যায়।
এছাড়া হাঁটা হচ্ছে সবচেয়ে সহজ ব্যায়াম, যেটা ফুসফুসকে অনেকটা সুস্থ রাখে। হাঁটার সময় শরীর বাড়তি অক্সিজেন চায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই শ্বাস নিতে হয় গভীরভাবে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়ে। অনেকে বলেন দৌড়ানো বা জগিং করলে আরও দ্রুত ফল মেলে, কারণ এতে শরীর বেশি পরিশ্রম করে এবং ফুসফুসকে বেশি কাজ করতে হয়। তবে যাদের বয়স বেশি বা শারীরিক অসুবিধা আছে তাদের জন্য হালকা হাঁটাই যথেষ্ট।
সাঁতারও একটি অসাধারণ ব্যায়াম ফুসফুসের জন্য। পানির ভেতর শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করা লাগে, যার ফলে ফুসফুস ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে সাঁতারুদের ফুসফুস সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি অক্সিজেন ধারণ করতে পারে। তবে আমাদের দেশে সবাই সাঁতারের সুযোগ পায় না। যাদের সুযোগ আছে তারা নিয়মিত সাঁতার কাটলে ফুসফুসের পাশাপাশি পুরো শরীরও ফিট থাকে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যায়াম হলো সিঁড়ি ওঠা। এটা অনেকটা দৌড়ানোর মতোই ফুসফুসে চাপ তৈরি করে। প্রতিদিন কয়েক মিনিট সিঁড়ি ওঠা-নামা করলে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়ে, ফলে ফুসফুসে অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা বেড়ে যায়। অনেকে হয়তো লিফট ব্যবহার করেন, কিন্তু সচেতন হলে প্রতিদিন অন্তত কয়েকতলা হেঁটে ওঠা যেতে পারে। এতে হৃদযন্ত্রও ভালো থাকে এবং ক্যালোরিও কমে।
গভীর শ্বাস নেওয়ার অনুশীলনও অত্যন্ত জরুরি। আমরা সাধারণত অল্প শ্বাস নিই, মানে বুকের ওপরের অংশ দিয়ে বাতাস নেই। কিন্তু যদি প্রতিদিন কয়েকবার গভীরভাবে শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস করি, তবে ফুসফুসের ভেতরের অচল অংশও সক্রিয় হয়। সহজভাবে চেয়ারে বসে বা দাঁড়িয়ে দু’হাত ছড়িয়ে গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিতে হয়। কয়েক মিনিট করলেই বোঝা যায় ফুসফুস হালকা হয়ে গেছে।
আজকাল ধূমপান, দূষণ, অনিয়মিত জীবনযাপন ফুসফুসকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। যারা ধূমপান করেন, তাদের ফুসফুস ধীরে ধীরে অক্সিজেন ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাই প্রথম শর্ত হলো ধূমপান ছেড়ে দেওয়া। পাশাপাশি প্রতিদিন সামান্য হলেও শারীরিক কসরত করতে হবে। অফিসে বসে থাকা মানুষদের জন্যও সহজ কিছু ব্যায়াম আছে—যেমন দাঁড়িয়ে হাত-পা প্রসারিত করা, শরীর বাঁকানো, কিংবা কিছুক্ষণ দ্রুত হাঁটা। এগুলো খুব বেশি শক্তি না নিলেও ফুসফুসকে সক্রিয় করে তোলে।
ব্যায়ামের পাশাপাশি প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়া ফুসফুসে অক্সিজেন বাড়াতে সাহায্য করে। শহরের ধোঁয়াশা, গাড়ির ধোঁয়া বা ধুলাবালি ফুসফুসকে দ্রুত দুর্বল করে দেয়। তাই সম্ভব হলে ভোরে পার্কে বা গাছপালার নিচে হাঁটা উচিত। গাছের কাছাকাছি বাতাস তুলনামূলক বিশুদ্ধ থাকে, এতে ফুসফুস সতেজ বোধ করে।
এ কথাও মনে রাখতে হবে, ফুসফুস শুধু শ্বাস নেওয়ার যন্ত্র নয়; এটি আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার সাথেও জড়িত। ফুসফুসে পর্যাপ্ত অক্সিজেন থাকলে শরীরের প্রতিটি কোষ ভালোভাবে কাজ করতে পারে। রোগ কম হয়, মন প্রফুল্ল থাকে। আবার ফুসফুস দুর্বল হলে মানুষ সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে, সামান্য পরিশ্রমেও হাঁপিয়ে যায়। তাই ব্যায়ামকে জীবনের অভ্যাস করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ফুসফুসে অক্সিজেন বাড়ানোর জন্য জটিল কোনো কৌশলের দরকার নেই। শুধু নিয়মিত ব্যায়াম, যেমন হাঁটা, দৌড়, সাঁতার, সিঁড়ি ওঠা বা গভীর শ্বাস নেওয়ার অনুশীলনই যথেষ্ট। তবে শৃঙ্খলা জরুরি। সপ্তাহে একদিন ব্যায়াম করে বাকিটা সময় বসে থাকলে ফুসফুস শক্তিশালী হবে না। প্রতিদিন অন্তত অর্ধঘণ্টা শরীর নড়াচড়া করতে হবে। এতে শুধু ফুসফুস নয়, পুরো শরীর ও মনও সুস্থ থাকবে।
তাই আজ থেকেই আমাদের ভাবতে হবে—শরীরের ভেতরে যে ফুসফুস দিনরাত অক্সিজেন সরবরাহ করছে তাকে আমরা কতটা যত্ন দিচ্ছি? ব্যস্ত জীবনের মাঝেও যদি প্রতিদিন সামান্য সময় ব্যায়ামের জন্য দিই, তবে ফুসফুস আমাদের দীর্ঘদিন সুস্থ ও প্রাণবন্ত রাখবে।