গণমঞ্চ ডেস্ক নিউজ
কাগজে-কলমে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বলে কিছু নেই। তবে রাষ্ট্র হিসেবে বহু দেশ এই ভূখণ্ডকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে, বিভিন্ন দেশে এই দেশের কূটনৈতিক মিশনও রয়েছে। এমনকি অলিম্পিকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণও করেন ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু ইসরাইলের সাথে ফিলিস্তিনের দীর্ঘসময়ের বিরোধের কারণে ফিলিস্তিনের কোনো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা, রাজধানী বা সেনাবাহিনী নেই।
পশ্চিম তীরে ইসরাইলের সেনাবাহিনীর বহু বছরের দখলদারিত্ব চলার পর ১৯৯০ এর দশকে ‘প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটি’ বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়, যাদের ওই ভূখণ্ড ও সেখানে বসবাসরত মানুষের ওপর পূর্ণ নিয়ণ্ত্রণ নেই। ইসরাইলের আগ্রাসনে গাজা এখন যুদ্ধক্ষেত্র।
কাজেই এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া অনেকটাই প্রতীকী। নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করলে এটি বেশ শক্ত পদক্ষেপ, কিন্তু বাস্তবতা হলো– এই সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি খুব একটা পরিবর্তন হবে না। তবে এই প্রতীকী পদক্ষেপও বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রায় ৭৫ ভাগই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের সদস্যপদ ‘স্থায়ী পর্যবেক্ষক’ হিসেবে। এর অর্থ- তারা জাতিসংঘের কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে, কিন্তু কোনো বিষয়ে ভোট দিতে পারবে না।
ব্রিটিশ আর ফরাসীদের স্বীকৃতির পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশের চারটির সমর্থনই পাবে ফিলিস্তিন। কারণ চীন আর রাশিয়া ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেটি হলে, ইসরাইলের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই একঘরে হয়ে পড়বে।
ওয়াশিংটন অবশ্য মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে স্বীকৃতি দেয়, যেটি ১৯৯০ এর দশকে গঠিত হয়েছিল। ওই ঘটনার পর থেকে অনেক দেশের প্রেসিডেন্টই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এদিকে, রোববার তিন দেশের স্বীকৃতি দেওয়ার পর পরস্পরবিরোধী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের বাসিন্দারা। বিবিসিকে তাদের কেউ কেউ বলেন, এই স্বীকৃতি একেবারে অর্থহীন নয়। আবার অন্যরা বলেছেন, এর মাধ্যমে কার্যত কিছুই হবে না।
রামাল্লায় ফিলিস্তিনিদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার স্বীকৃতির পর সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পশ্চিম তীরের রামাল্লার বাসিন্দারা।
রামাল্লা শহরটি জেরুজালেমের উত্তরের অবস্থিত, যেখানে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক সদর দপ্তর রয়েছে।
সেখানকার বাসিন্দা ৩০ বছর বয়সী মোহাম্মদ হাসিব বলছিলেন, ‘এটা চমৎকার সংবাদ। আমরা আশা করি, সব ইউরোপীয় দেশ এটা অনুসরণ করে আমাদের দেশকে স্বীকৃতি দেবে, যার মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান হবে।’
আরেকজন নারী বলছিলেন, ‘এটার জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে, কিন্তু এটা একেবারে অর্থহীন নয়।’
কিন্তু অনেকের মধ্যে এই আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে যে, এই স্বীকৃতির পর ইসরাইলি সরকার হয়তো তাদের দমনপীড়ন আরো বাড়িয়ে দেবে। এর মধ্যেই ইসরাইলি সরকার পশ্চিম তীর জুড়ে নতুন বসতি তৈরির পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে শুরু করেছে। অনেক মন্ত্রী হুমকি দিচ্ছেন যে, বেশ কিছু এলাকা তারা ইসরাইলের সাথে যুক্ত করে নেবে।
যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতি হামাসের জন্য পুরস্কার ছাড়া আর কিছু নয়
অপরদিকে, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাজ্য যে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেটি ‘জিহাদি’ হামাসের জন্য পুরস্কার ছাড়া আর কিছু নয় বলে মন্তব্য করেছে ইসরাইল। তাদের মতে, এটি যুক্তরাজ্যে থাকা তাদের (হামাস) মুসলিম ভাইদের উৎসাহে এটা ঘটেছে।
বিবিসি জানিয়েছে, ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি এক বার্তায় লিখেছে, ‘হামাসের নেতারা প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন যে, ‘এটি হলো ৭ অক্টোবরের গণহত্যার সরকারি স্বীকৃতি’।
ব্রিটিশ গণমাধ্যমটি জানিয়েছে, হামাস এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
“এই স্বীকৃতি আমাদের ফিলিস্তিনি জনগণের তাদের ভূমি এবং পবিত্র স্থানগুলিতে অধিকার নিশ্চিত করার এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ”, হামাসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, কয়েক যুগের হত্যা, দমনপীড়ন ও দখলদারিত্বের প্রতিবাদে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলি ভূখণ্ডে প্রবেশ করে হামলা চালায় হামাসের যোদ্ধারা। ওই হামলায় ১২০০ লোক মারা যাওয়ার দাবি করে আসছে ইসরাইল। সেই সঙ্গে দুই শতাধিক লোককে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে আসে হামাস যোদ্ধারা। এর জবাবে ওই দিন থেকেই গাজায় অবর্ণনীয় হামলা শুরু করে ইসরাইল, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে ইসরাইলের হামলায় সরকারি হিসাবে অন্তত ৬৫ হাজার নীরিহ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। সেই সঙ্গে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা নগরী।
এই অবস্থার মধ্যেই উল্লিখিত তিনটি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিল। তবে এই স্বীকৃতির পর গাজা তথা ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি কোন দিকে যায়- তা দেখার জন্য আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নেয়- সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুরু থেকেই গাজা যুদ্ধে ইসরাইলকে সমর্থন ও যাবতীয় সহযোগিতা করে আসছে ওয়াশিংটন। এমনকি জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পক্ষে প্রস্তাব পাশের ক্ষেত্রে বার বার ভেটো দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।