পাঁচ ব্যাংক এক করতে লাগবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা

গণমঞ্চ ডেস্ক

দুর্বল পাঁচ ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক মিলে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার রূপরেখার খসড়া তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়ায় প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন বিনিয়োগ হিসেবে সরকারের কাছে চাইবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া আমানত বীমা তহবিল থেকে ঋণ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার কাছে তহবিল চেয়ে আবেদন করা হবে। প্রস্তাবিত রূপরেখার ওপর সরকারের সম্মতি চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক মিলে একটি ব্যাংক করা হচ্ছে। একীভূতকরণের আগে এসব ব্যাংকের সব শেয়ার শূন্য করা হবে। একীভূত করার শুরুর দিকে আমানত উত্তোলনের চাপ তৈরি হবে। প্রাথমিকভাবে ক্ষুদ্র আমানত ফেরত দেওয়া হবে। আর প্রাতিষ্ঠানিক আমানত শেয়ারে রূপান্তর করা হবে। নতুন আমানত সংগ্রহ এবং ঋণ আদায় জোরদার করা হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির সুরক্ষা দেওয়া হবে। বিশেষ করে অনিয়ম-জালিয়াতিতে সম্পৃক্ততা নেই এবং নিয়ম মেনে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের চাকরির সুরক্ষা থাকবে।

একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান বা একিউআর রিপোর্টের ভিত্তিতে গত মে মাস থেকে অভ্যন্তরীণ আলোচনা করছে। এসব ব্যাংকের কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে একীভূত করার প্রস্তাবিত কাঠামো তৈরি করেছে। চলতি সপ্তাহে যা গভর্নরের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। গভর্নর শিগগিরই এ কাঠামো নিয়ে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করবেন এবং ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল চেয়ে চিঠি দেবেন।

জানা গেছে, সরকারের সম্মতি পাওয়া ব্যাংকগুলোর পর্ষদ বাতিল করে আলাদা একটি পর্ষদ গঠন করা হবে। সরকারের ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর সব ব্যাংকের চাঁদায় গড়ে ওঠা আমানত বীমা ট্রাস্ট তহবিল থেকে ঋণ হিসেবে আট থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হবে। এ জন্য আমানত বীমা আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আইনে আমানত বীমা তহবিল থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ড ছাড়া অন্য কোথাও বিনিয়োগের সুযোগ নেই। বর্তমানে এ তহবিলে ১৬ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। বাকি অর্থ আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ‘পুনরুদ্ধার তহবিল’ হিসেবে নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও ব্যাংক সংস্কার কমিটির সদস্য ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, এসব ব্যাংকে বড় অঙ্কের মূলধন ঘাটতি হয়েছে। একীভূত করার উদ্যোগ সফল হলে বিশ্বের সামনে নতুন নজির স্থাপন হতে পারে। তাঁর সুপারিশ, একীভূত করার পর নতুন ব্যাংকে ভালো একটি পরিচালনা পর্ষদ এবং দক্ষ একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। আমানতকারী এবং কর্মীদের স্বার্থ দেখতে হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, সরকারের সম্মতি পাওয়ার পর একেবারে নতুন ব্যাংক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি লাইসেন্স ইস্যু হবে। এর পর আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে ব্যাংকটি সরকারি হিসেবে পরিচালিত হবে। সরকারের পক্ষে পরিচালনগত দিক দেখাশোনা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকটির জন্য মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনে অফিস ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে।

তারা জানান, বিভিন্ন পর্যায় থেকে তহবিল নিয়ে ব্যাংকটি তিন থেকে পাঁচ বছর সরকারি মালিকানায় চলবে। এর পর বেসরকারি খাতে বিক্রি করে দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক বহুজাতিক কোনো সংস্থা নতুন ব্যাংকের মালিকানায় যুক্ত হতে পারে। ব্যাংকটি বিক্রির পর মুনাফাসহ সরকারের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। নতুন ব্যাংকের জন্য ইসলামী ব্যাংকিং, আর্থিক খাত, তথ্য প্রযুক্তি এবং আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে স্বতন্ত্র একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নিয়ে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞ একজনকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেবে। পাঁচটি ব্যাংকের অনেক ক্ষেত্রে একই এলাকায় একাধিক শাখা রয়েছে। এতে করে কর্মী ছাঁটাইয়ের একটি প্রশ্ন আসবে। তবে কর্মীদের গণহারে যেন ছাঁটাই করতে না হয়, সে লক্ষ্যে গ্রামীণ এলাকায় নতুন শাখা খোলা হবে। এ ছাড়া কোনো এলাকা থেকে সংগৃহীত আমানতের বেশির ভাগ সেই এলাকায় বিনিয়োগ করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ব্যাংকের আমানত ধারাবাহিকভাবে কমে গত মে পর্যন্ত এক লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকায় নেমেছে। গত বছরের মার্চ পর্যন্ত মোট আমানত ছিল এক লাখ ৪৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল এক লাখ ৫৮ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। আমানত কমার বিপরীত চিত্র রয়েছে ঋণে। সুদসহ নিয়মিতভাবে ঋণস্থিতি বেড়ে যাচ্ছে। গত মে পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৯৫ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। গত মার্চে যা ছিল এক লাখ ৯৩ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল এক লাখ ৯১ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে পাঁচটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। মোট ঋণের যা প্রায় ৭৭ শতাংশ। বিপুল অঙ্কের এ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। শতাংশ বিবেচনায় সর্বোচ্চ ৯৮ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক। পর্যায়ক্রমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামীর ৬২ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮ শতাংশ। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ধার হিসেবে সর্বোচ্চ সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা নিয়েছে এক্সিম ব্যাংক। পর্যায়ক্রমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী নিয়েছে সাত হাজার ৫০ কোটি, এসআইবিএল ছয় হাজার ৬৭৫ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী দুই হাজার ২৯৫ কোটি ও ইউনিয়ন ব্যাংক দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আমানতকারীদের আস্থা ফেরানোই একীভূতকরণ উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য। যে কারণে নতুন ব্যাংকটিকে নানাভাবে সহায়তা এবং ছাড় দেওয়া হবে। বিদ্যমান নিয়মে শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত একটি ইসলামী ব্যাংকের মোট আমানতের ৪ শতাংশ বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) এবং সাড়ে ৫ শতাংশ বিধিবদ্ধ তারল্য (এসএলআর) হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। কোনো ব্যাংক এতে ব্যর্থ হলে নির্ধারিত হারে জরিমানা গুনতে হয়। নতুন ব্যাংক শুরুর দিকে এ ক্ষেত্রে ছাড় পাবে।

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *