গণমঞ্চ ডেস্ক
ফারমার্স থেকে নাম বদলে হয় পদ্মা ব্যাংক। সেই ব্যাংক লুটের এক নম্বর কারিগর ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ড. মহীউদ্দীন খান (মখা) আলমগীর। তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান থাকার সময়ে প্রায় ৩৩০০ কোটি টাকা লুট হয়। তার সহযোগী বাবুল চিশতির মাধ্যমে লুট হয় আরও প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা। এভাবেই পদ্মা ব্যাংকের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা হাওয়া হয়ে যায়। বর্তমানে ব্যাংকটির মন্দমানের খেলাপি ঋণ প্রায় ৮৬ শতাংশ। এর মধ্যে বাবুল চিশতির সাজা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে মখা আলমগীর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা দূরে থাক, ভয়ে কেউ কথা বলারও সাহস পাননি। একটি সূত্রের দাবি, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন মখা আলমগীর। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদন, পদ্মা ব্যাংকের প্রতিবেদন ও যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব তথ্য। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা ব্যাংকের ওপর এখন ফরেনসিক অডিট করা জরুরি। তাহলেই বেরিয়ে আসবে অচল ও মৃতপ্রায় ব্যাংকটিতে লুটপাটের পুরো চিত্র।
জানা গেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী নেতা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ওরফে মখা আলমগীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ। সংস্থাটির সর্বশেষ তদন্তে দেখা গেছে, তার নিজের নামে, স্ত্রী সিতারা আলমগীরের নামে এবং পরিবারের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মোট ৩৯৮ কোটি ৯১ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ২০০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা জমা হয়েছে এবং ১৯৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। বর্তমানে অ্যাকাউন্টগুলোতে অবশিষ্ট আছে মাত্র ২ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আদালতের নির্দেশে এসব অ্যাকাউন্ট পুনরায় স্থগিত করা হয়েছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ পাচার : বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, মখা আলমগীর মন্ত্রী থাকাবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। সেই অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয় এবং ভুয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা নয়ছয় করা হয়। কখনো নিজের নামে, কখনো স্ত্রীর নামে আবার কখনো তথাকথিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এসব অবৈধ কার্যক্রমে পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) ছাড়াও আইএফআইসি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক ব্যবহৃত হয়েছে।
ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লেনদেন : তদন্তে উঠে এসেছে, ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের জন্য বেশ কয়েকটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শুভ অটোরাইস মিল, সুলতানা ফিলিং স্টেশন, মেসার্স সুলতানা অয়েল মিল, গুলবাহার হিমাগার লিমিটেড ও সুলতানা ফাউন্ডেশন। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদন নিয়ে তা অন্যত্র সরিয়ে ফেলা এবং আমানতকারীদের অর্থ আত্মসাৎ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা : বিএফআইইউর প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, মখা আলমগীর ও তার স্ত্রী প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ২(শ)(১৯) ধারায় কর-সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে অধিকতর অনুসন্ধান, তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি : ২০১৩ সালে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসাবে অনুমোদন পাওয়া ফারমার্স ব্যাংক শুরুর পরপরই অবৈধ নিয়োগ-বাণিজ্য, নিয়মবহির্ভূত ঋণ বিতরণ এবং অর্থ লোপাটে জড়িয়ে পড়ে। চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্বে থাকা মখা আলমগীর এবং নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতি এ কেলেঙ্কারির মূল হোতা ছিলেন। তারা শুধু অবৈধ ঋণ অনুমোদনই দেননি, বরং গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট থেকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে নিজেদের অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করেছেন। এ অপরাধকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ‘নৈতিকস্খলন’ হিসাবে উল্লেখ করে।
গ্রাহকের টাকায় লুটপাট : ব্যাংকের অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে একপর্যায়ে গ্রাহকরা শাখায় ভিড় করেও নিজেদের জমানো টাকা ফেরত পাননি। এমনকি সরকারের জলবায়ু তহবিলের অর্থও ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছিল ব্যাংকটি। পরিস্থিতির অবনতির কারণে ২০১৭ সালে মখা আলমগীরকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সরকারের হস্তক্ষেপে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক রাখা হয়।
পদ্মা ব্যাংকে সরকারি মালিকানা : সংকটে পড়া ব্যাংকটিকে বাঁচাতে সরকারের উদ্যোগে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) হাতে প্রায় ৭০ শতাংশ শেয়ার হস্তান্তর করা হয়। বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ করে ৭১৫ কোটি টাকা। এরপর ২০১৮ সালে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব নেন। তার নেতৃত্বে কিছু সময় ব্যাংকটি স্থিতিশীলতা ফিরে পেলেও পরবর্তীতে নতুন করে লুটপাট ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। বর্তমানে সরাফাতও পদত্যাগ করে বিদেশে অবস্থান করছেন।
প্রসঙ্গত, মাহবুবুল হক চিশতি ওরফে বাবুল চিশতি ও তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতিকে ব্যাংকটির প্রায় ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে পাচারের অভিযোগে ১২ বছর কারাদণ্ড দেন আদালত।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শওকত আলী খান যুগান্তরকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পদ্মা ব্যাংকের বিষয়ে একটি সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। তবে এ মুহূর্তে ব্যাংকের অনাবশ্যক ব্যয় কমিয়ে আনা এবং খেলাপি ঋণ আদায় থেকে আমানতকারীদের কিছু কিছু অর্থ ফেরত দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। সার্বিক বিষয়ে একটি সমাধানের চেষ্টা চলছে।