গণমঞ্চ নিউজ ডেস্ক –
কয়েকদিন আগেই ভারতের নির্বাচন কমিশন বিহার রাজ্যের জন্য সংশোধিত খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে। আগামী নভেম্বরে এই রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। মাসব্যাপী ভোটার তালিকা সংশোধনের এক বিশাল কর্মযজ্ঞের পর এই নতুন তালিকা প্রকাশ করা হয়। খবর বিবিসির।
কিন্তু এই তালিকা প্রকাশের পরই শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। বিরোধী দল এবং নির্বাচন নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর অভিযোগ, পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে শেষ করা হয়েছে। বিহারের বহু ভোটার বিবিসিকে জানিয়েছেন, নতুন এই খসড়া তালিকায় ছবিতে মারাত্মক ভুল রয়েছে এবং এমন অনেকের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যারা বহু বছর আগেই মারা গেছেন।
এই তালিকা সংশোধনের জন্য ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে এবং এর মধ্যেই ১ লক্ষ ৬৫ হাজারেরও বেশি আবেদন জমা পড়েছে।
তবে বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, আসন্ন রাজ্য নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই ইচ্ছাকৃতভাবে বহু ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী চারটি জেলার মুসলিমদের, যারা জনসংখ্যার একটি বড় অংশ।
নির্বাচন কমিশন এবং বিজেপি উভয়ই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বিবিসির প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, কোনো যোগ্য ভোটার যাতে ‘বাদ না পড়েন’ তা নিশ্চিত করার জন্য তারা সবরকম চেষ্টা করেছে। তারা আরও যোগ করে, ‘কিছু স্বার্থান্বেষী মহল যে সমস্ত ভুল তথ্য বা ভিত্তিহীন অভিযোগ ছড়াচ্ছে, তার কোনো দায় কমিশন নেবে না।’
কমিশন বাদ পড়া নামের তালিকা বা ধর্মভিত্তিক কোনো তথ্য প্রকাশ না করায় বিরোধীদের অভিযোগ যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না।
তবে ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ পত্রিকার একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিহারে সবচেয়ে বেশি মুসলিম অধ্যুষিত জেলা কিষাণগঞ্জে ভোটার বাদ পড়ার হার অনেক বেশি, যদিও অন্যান্য মুসলিম প্রধান এলাকায় তেমনটা দেখা যায়নি।
এডিআর-এর জগদীপ ছোকার বিবিসিকে বলেন, “বিধানসভা নির্বাচনের মাত্র তিন মাস আগে এই কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে এবং এর জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়নি।” তিনি আরও যোগ করেন, “মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, যখন এই তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছিল, তখন ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে এবং পুরো প্রক্রিয়াটিই ত্রুটিপূর্ণ ছিল।”
এডিআর আদালতে যুক্তি দিয়েছে যে, এই কর্মসূচির ফলে ভারতের অন্যতম দরিদ্র এবং “বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর” রাজ্য বিহারে “লক্ষ লক্ষ প্রকৃত ভোটার তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন”। তাদের মতে, এই প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অল্প সময়ের মধ্যে তাদের নিজেদের এবং তাদের বাবা-মায়ের নথি জমা দিতে বলা হচ্ছে, যা লক্ষ লক্ষ গরিব ও পরিযায়ী শ্রমিকের জন্য এক অসম্ভব কাজ।
এই ঘটনাকে ‘গণতন্ত্রের ওপর হুমকি’ আখ্যা দিয়ে বিরোধী সাংসদরা সংসদে আলোচনার দাবিতে বারবার অধিবেশন মুলতবি করতে বাধ্য করছেন। সংসদের বাইরে তারা “মোদি হটাও”, “এসআইআর বাতিল করো” এবং “ভোট চুরি বন্ধ করো” স্লোগান দিচ্ছেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা এডিআর এই পদক্ষেপের সময় নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর ভারতের সুপ্রিম কোর্টও বিষয়টি পর্যালোচনা করছে।
খসড়া তালিকা প্রকাশের সময় পাটনা এবং তার কাছাকাছি গ্রামগুলোতে গিয়ে নানান চিত্র দেখা যায়।
দানারা গ্রামে, যেখানে রাজ্যের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ‘মহাদলিত’-দের বাস, সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই উচ্চবর্ণের জমিতে কাজ করেন অথবা বেকার। তাদের বাড়িগুলো জরাজীর্ণ, সরু গলির পাশে খোলা নালা এবং মন্দিরের কাছের একটি ডোবার জল অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়েছে।
গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই ‘এসআইআর’ বা এর প্রভাব সম্পর্কে কিছুই জানেন না। কর্মকর্তারা আদৌ তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন কিনা, তা নিয়েও অনেকে সন্দিহান। কিন্তু তারা তাদের ভোটকে অত্যন্ত মূল্যবান বলে মনে করেন। রেখা দেবী নামে এক বাসিন্দা বলেন, “ভোটের অধিকার হারানো হবে এক বিরাট বিপর্যয়। এটা আমাদের আরও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেবে।”
খারিকা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। সেখানকার অনেক পুরুষই জানিয়েছেন যে তারা এসআইআর-এর কথা শুনেছেন এবং নতুন ছবি তোলার জন্য ৩০০ রুপি খরচ করে ফর্ম জমা দিয়েছেন। কিন্তু খসড়া তালিকা প্রকাশের পর কৃষক এবং অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তারকেশ্বর সিং পুরো বিষয়টিকে “এ এক হযবরল অবস্থা” বলে বর্ণনা করেন। তিনি তার পরিবারের তথ্যের পাতাগুলো দেখিয়ে বলেন, তার নামের পাশে যার ছবি রয়েছে, তাকে তিনি চেনেনই না।
তিনি আরও বলেন, “আমি জানি না এটা কার ছবি। শুধু তাই নয়, আমার স্ত্রী সূর্যকলা দেবী এবং ছেলে রাজীবের ছবিতেও ভুল রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ অবস্থা আমার অন্য ছেলে অজীবের ক্ষেত্রে – তার নামের পাশে এক অচেনা মহিলার ছবি দেওয়া হয়েছে।”
তারকেশ্বর সিং আরও অনেক অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেন। তার পুত্রবধূ জুহি কুমারীর নথিতে, তার ছেলের জায়গায় তার নিজের নাম স্বামীর হিসেবে লেখা হয়েছে। আরেক পুত্রবধূ সঙ্গীতা সিংয়ের নাম একই ঠিকানা থেকে দুবার তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে কেবল একটিতে তার সঠিক ছবি এবং জন্ম তারিখ রয়েছে।
তিনি জানান, তার অনেক আত্মীয় এবং প্রতিবেশীরও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি তার এক ভাইয়ের নাম দেখান, যিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় আগে মারা গেছেন কিন্তু এখনও তালিকায় তার নাম রয়েছে। এছাড়া অন্তত দুটি নাম তালিকায় দুবার এসেছে।
তার ভাষ্যে, “বোঝাই যাচ্ছে কোনো যাচাই করা হয়নি। তালিকায় মৃত ব্যক্তি, নকল নাম এবং এমন অনেকের নামও রয়েছে যারা ফর্মই পূরণ করেনি। এটা সরকারি ব্যবস্থার এবং এই কাজে ব্যয় হওয়া কোটি কোটি টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।”
এই ভোটার তালিকা নিয়ে বিহারের রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত। বিরোধী রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন জনতা দল (ইউনাইটেড) ও বিজেপির জোট একে সমর্থন করছে।
আরজেডি-র সাধারণ সম্পাদক শিবানন্দ তিওয়ারি বলেন, “এই সংশোধনের জটিলতা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।” তিনি নির্বাচন কমিশনের এই দাবি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন যে, “৯৮.৩% ভোটার তাদের ফর্ম পূরণ করেছেন”। তিওয়ারি অভিযোগ করেন, “কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট এবং এটা নির্বাচনকে প্রভাবিত করার একটা ষড়যন্ত্র। আমাদের ধারণা, তাদের লক্ষ্য সীমান্তবর্তী এলাকা, যেখানে প্রচুর মুসলিম বাস করেন, যারা কখনও বিজেপিকে ভোট দেয় না।”
অন্যদিকে, বিজেপি এবং জেডি(ইউ) এই সমালোচনাকে “সম্পূর্ণ রাজনৈতিক” বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
বিহারের বিজেপি সাংসদ ভীম সিং বলেন, “কেবলমাত্র ভারতীয় নাগরিকদেরই ভোট দেওয়ার অধিকার রয়েছে এবং আমরা বিশ্বাস করি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রচুর রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি সীমান্তবর্তী এলাকায় বসতি স্থাপন করেছে। তাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া আবশ্যক।” তিনি আরও বলেন, “এসআইআর-এর সঙ্গে কোনো ধর্মের সম্পর্ক নেই। বিরোধীরা জানে যে তারা আসন্ন নির্বাচনে হারবে, তাই হারের দায় চাপানোর জন্য একটা অজুহাত খুঁজছে।”
এই বিতর্ক কতদূর গড়ায়, এবং নভেম্বরের নির্বাচনের আগে বিহারের সাধারণ মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।