ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত: বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর

গত এক বছরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত—রবিবার এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ ম্যানসুর। তিনি বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নেওয়া নানা পদক্ষেপের ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি বলেন, “গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংক খাত ছিল একেবারে প্রান্তসীমায়।”

তিনি বলেন, “আমাদের মূল দুটি চ্যালেঞ্জ ছিল সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল করা এবং আর্থিক খাতে সংস্কার আনা। এক বছরে সংস্কার সম্ভব না হলেও, প্রতিটি খাতে আমরা এর সূচনা করেছি।”

গভর্নর জানান, দায়িত্ব নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে ঋণ সুবিধা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।

“আমরা তাদের আশ্বস্ত করেছি, প্রতিটি পয়সা পরিশোধ করব—এবং আমরা তা করেছি। আমাদের অবস্থা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো হয়নি,” বলেন তিনি।

তার মতে, গত এক বছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের মাধ্যমেই ঋণ পরিশোধে সবচেয়ে বেশি সহায়তা মিলেছে।

মূল চ্যালেঞ্জ ছিল মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ

গভর্নর জানান, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

তিনি বলেন, “গত বছরের ১৪ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে এক ডলারও বিক্রি করেনি, বরং টাকায় চাপ থাকা সত্ত্বেও ১২২ টাকায় ডলার কিনেছে।”

এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে নেমেছে এবং ভবিষ্যতে তা ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বিনিয়োগে এখনও ধীরগতি

বর্তমানে পেমেন্ট ব্যালেন্স উদ্বৃত্ত থাকলেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনও পিছিয়ে আছে অর্থনীতি, বলেন গভর্নর।

“নির্বাচনের আগে বড় বিনিয়োগ আসবে না, তবে নির্বাচনের পর বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি,” জানান তিনি।

ব্যাংকিং কমিশন নয়, তিনটি টাস্কফোর্স

ব্যাংকিং কমিশন গঠন না করার বিষয়ে গভর্নর বলেন, কমিশন গঠনে ৬–৯ মাস সময় লাগত এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হতো। এজন্য তিনটি পৃথক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে—ব্যাংক খাত সংস্কার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম উন্নয়ন এবং পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে কাজ করার জন্য।

তবে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা সবচেয়ে কঠিন কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি, কারণ এটি ৮-১০টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের বিষয়।

বড় আইনি সংস্কার আসছে

গভর্নর বলেন, বড় আইনি সংস্কারের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • ব্যাংক কোম্পানি আইনে ব্যাপক সংশোধনী
  • মানি লন্ডারিং আইনে মৌলিক পরিবর্তন ও সম্পদ পুনরুদ্ধারের ধারা সংযোজন
  • বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারে সংশোধনী এনে স্বায়ত্তশাসন ও জবাবদিহিতা বাড়ানো
  • ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স আইন এবং মানি লোন কোর্ট আইন সংশোধন করে পুরনো ঋণ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা

দুর্বল ব্যাংক দখলের ক্ষমতা পাবে বাংলাদেশ ব্যাংক

‘বাংলাদেশ ব্যাংক রেজোলিউশন অর্ডিন্যান্স’-এও পরিবর্তন আনা হবে যাতে অনিয়মজনিত কারণে তারল্য সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো সরাসরি অধিগ্রহণ করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

“আর কোনো ছাড় নয়। কোনো ব্যাংক সুষ্ঠুভাবে চলতে না পারলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি অধিগ্রহণ করবে,” হুঁশিয়ারি দেন গভর্নর।

তিনি জানান, সব ব্যাংকের ওপর সমন্বিত নজরদারির জন্য একটি একক সংস্থা গঠনের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে।

নগদবিহীন অর্থনীতির পথে উদ্যোগ

বাংলাদেশকে ক্যাশলেস অর্থনীতির পথে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন গভর্নর। এর মধ্যে রয়েছে:

  • কিউআর কোডের প্রচলন
  • ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে উৎসাহ
  • ক্ষুদ্র ঋণ (ন্যানো লোন) সম্প্রসারণ
  • স্কুল পর্যায়ে ব্যাংকিং শিক্ষা
  • আবাসন খাতে সংস্কার
  • রাজস্ব বিভাগ পুনর্গঠন
  • স্মার্টফোনের দাম কমানো, যাতে ডিজিটাল ব্যাংকিং আরও বিস্তৃত হয়

গভর্নর আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এই সকল পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নতুন এক স্থিতিশীল ও আধুনিক ধাপে প্রবেশ করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *