গণমঞ্চ নিউজ ডেস্ক –
পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সরাসরি গুমের অভিযোগ দিয়েছেন অন্তত তিন তরুণ। ‘গুম তদন্ত কমিশন’-এ তারা লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন এবং তাদের ওপর চালানো নিপীড়নের বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।
তারা বলেছেন, ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যরা তাদের সিভিল পোশাকে অপহরণ করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) কার্যালয়ের গোপন সেলে দীর্ঘদিন গুম করে রেখেছিল।
ওই তিন তরুণ হলেন সাজিদুল ইসলাম, ইফাজ আহমেদ ও সাজ্জাদুর রহমান শাওন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী এই ‘গুম’ অপারেশন পরিচালিত হয় সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মদত ও সিটিটিসির মাধ্যমে।
তারা বলেন, এই পুরো প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনা ছাড়াও তার উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার শফিকুল ইসলামসহ উচ্চপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন। বর্তমানে অভিযুক্তরা সবাই পলাতক।
গুমের সময় সিটিটিসির বিভিন্ন কর্মকর্তার নামও প্রকাশ করেন তারা—যাদের মধ্যে ছিলেন এডিসি আহামেদুল ইসলাম, এসি ওবাইন, ইন্সপেক্টর আবুল বাশার, ইন্সপেক্টর মেজবাহ উদ্দিন, এসআই ফিরোজ মোল্লা, এসআই আশুতোষ শীল, এএসআই উজ্জ্বল, কনস্টেবল মাহতাব ও জহির এবং প্রধান হিসেবে উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আছাদুজ্জামান।
তিনজনের জবানবন্দিতেই উঠে এসেছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ভয়ঙ্কর চিত্র, যা শুধু তাদের ব্যক্তিগত জীবন নয়, বরং তাদের পরিবারকেও ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। গুমের শিকাররা জানিয়েছেন, তাদের বিনা কারণে তুলে নিয়ে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, মিথ্যা মামলা এবং ভুয়া স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয়।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা শেষ করে ‘দারাজ’-এ কর্মরত ছিলেন সাজিদুল ইসলাম। ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে দারাজের অফিস থেকে সিভিল পোশাকধারী ১০ থেকে ১২ জন তাকে অপহরণ করে। অফিসের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, অস্ত্রের মুখে তাকে নিয়ে যায় অপহরণকারীরা। তাকে চোখ-মুখ বেঁধে ও হাতকড়া পরিয়ে মিন্টো রোডের সিটিটিসি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যেটা তিনি পরে বুঝতে পারেন। সেখানে ৭ মাসেরও বেশি সময় ধরে একটি সেলে বন্দি রাখা হয়।
তাকে নিয়মিত শারীরিক নির্যাতন করা হতো, ভিন্ন ভিন্ন অপরাধী বা সন্দেহভাজন জঙ্গির ছবি দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হতো। সাজিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি না জেনেও অপরাধ স্বীকারে বাধ্য হচ্ছিলাম না বলে আমার ওপর লাগাতার নির্যাতন চালানো হয়। তারা বলেছিল আমাকে ক্রসফায়ারে মারা হবে।’
সাজিদুল জানান, সিটিটিসির ৭ তলার বন্দিশালায় ১২টি সেল রয়েছে, যার একটিতে তাকে রাখা হয়। শীতকালে ঠাণ্ডা, গরমে দম বন্ধ পরিস্থিতি, নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত খাবার, ওয়াশরুমের ট্যাপের পানি খাওয়া এবং দিনের পর দিন সূর্যের আলো না দেখা—এমন বাস্তবতায় তার মানবিক অস্তিত্ব চরমভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ে। নির্যাতনের ফলে তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।
৭ মাস পর ২০২২ সালের ১৬ জুলাই যাত্রাবাড়ী থানায় সাজিদুলের নামে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার পরও তিনি জামিন পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেন এবং আজও সেই মামলায় হাজিরা দিতে হয়। পরিবারকে সহায়তা, উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন—সবই ধূলিসাৎ হয়ে যায় গুম ও মামলার কারণে।
সাজিদুল জানান, তার নামে মামলার চার্জশিটে দুজন সহ-আসামি হিসেবে দেখানো হয়, যাদের তিনি মামলার দিনই প্রথম দেখেন। তারা হলেন ইফাজ আহমেদ ও সাজ্জাদুর রহমান শাওন। তাদেরও সাজিদুলের আগে কয়েক মাস গুম করে রাখা হয়। একইভাবে গুম, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার শিকার হন তারা। গুমের পর রিমান্ডে নিয়ে তাদেরও স্বীকারোক্তি দিতে চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু কেউই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেননি।
সাজিদ অভিযোগ করে বলেন, এই বাহিনীগুলো দেশের ভেতরে একটি গুম ও নির্যাতনের নেটওয়ার্ক চালাত, যার পৃষ্ঠপোষকতা ও নির্দেশদাতা ছিলেন শেখ হাসিনা এবং তার ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক উপদেষ্টারা।
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সাজ্জাদুর রহমান শাওনের বয়স তখন ২৬। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) ছাত্র ছিলেন তিনি। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল রমজানের ইফতার শেষে কম্পিউটার মার্কেটে যাওয়ার পথে তাকে গুম করা হয়। সাদা পোশাকে থাকা তিনজন পরিচয় দেয় এডিসি আহমেদুল ইসলাম, এসি ওবাইন এবং এসআই আবুল বাশার হিসেবে।
তাকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। সেখানে অস্ত্রধারী আরো কয়েকজন ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার ফোন ও মানিব্যাগ কেড়ে নিয়ে মুখে কালো কাপড় বেঁধে চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন। গন্তব্য ছিল মিন্টো রোডে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সেই ৭ তলা, যেখানে পরবর্তী ১০০ দিন তাকে গোপনে বন্দি রাখা হয়।
শাওনের অভিযোগ, তাকে প্রতিদিন নির্যাতন করা হতো। ধর্মীয় বিশ্বাস ও পোশাককে কেন্দ্র করেও তাকে অপমানিত করা হয়। তার ভাষায়, ‘আমি কোরআন চেয়েছিলামÑএই অপরাধে আমাকে গালিগালাজ করা হয়েছে।’
সার্বক্ষণিক নিঃসঙ্গ বন্দিত্বের মধ্যে তার খাবার ও পানি নিয়েও অমানবিক আচরণ করা হয়। শাওন জানান, ‘পচা-দুর্গন্ধময় ওয়াশরুমের পানি খেয়ে থাকতে হতো। দুটি ঈদ কাটে বন্দি অবস্থায়; পরিবার কোনো খোঁজ পায়নি।’ পরে ১৬ জুলাই ২০২২ তারিখে তাকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ‘মিথ্যা মামলায়’ গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আদালতে তোলার আগে তাকে হুমকি দিয়ে বলা হয়, ‘তুই কোর্টে বলবি তুই জঙ্গি ছিলি, না বললে তোকে ১০টা মামলা দেওয়া হবে, ক্রসফায়ারও দেওয়া হতে পারে।’ তবে আদালতে বিচারক শাওনের শারীরিক অবস্থা দেখে বিস্মিত হন এবং তাকে অভয় দেন। পরে জামিন পেতে তার ৮ মাস লেগে যায়। ২০২৩ সালের প্রথম রমজানে তিনি অবশেষে মুক্তি পান।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী ছিলেন ইফাজ আহমেদ চৌধুরী। ২০২২ সালের ১১ এপ্রিল বেলা আড়াইটার দিকে মিরপুর-১-এর সনি সিনেমা হল-সংলগ্ন একটি শোরুমের পাশ থেকে নিখোঁজ হন তিনি। সে সময় নিজের গৃহপালিত বিড়ালের চিকিৎসার পর নামাজ পড়ে বাসায় ফিরছিলেন ইফাজ। পথে একটি কালো মাইক্রোবাস থেকে দুজন লোক নেমে এসে তাকে জোর করে গাড়িতে তোলে। প্রথমে চোখ বেঁধে, মাথা নিচু করিয়ে ঘণ্টাখানেক ঘোরানোর পর ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাকে একটি অচেনা ব্যক্তির ছবি দেখিয়ে সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
ইফাজ বলেন, ‘আমি ছবিতে থাকা লোকটি নই—এটা বারবার বললেও আমাকে ৩ মাস ৫ দিন গুম করে রাখা হয়। এরপর ১৬ জুলাই যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রেপ্তারের নাটক সাজিয়ে আমার নামে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়।’
এই তিন ভুক্তভোগী সরাসরি বলেন, তারা শুধু স্থানীয় বাহিনীর দ্বারা নয়, বরং শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশ বা নীতির অংশ হিসেবে গুম হয়েছেন। তারা অভিযোগ করেন, এই রাষ্ট্রীয় অপরাধ একটি পরিকল্পিত কৌশলের অংশ, যার মাধ্যমে বিরুদ্ধ মত, ধর্মীয় চর্চা বা স্বাধীন মতপ্রকাশ দমন করা হয়।
তারা প্রত্যেকেই গুমের সময় ও স্থান, নিপীড়নের ধরন এবং পরবর্তী মামলা-নাটকের বিবরণ দিয়ে লিখিত জবানবন্দি জমা দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে এই অভিযোগগুলো পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানা গেছে। অভিযোগপত্রে পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনাসহ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী তরুণরা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেখ ওমর বলেন, ‘শুধু সাজিদুল নয়, অনেক ভুক্তভোগী ও মানবাধিকার সংস্থাও বহু বছর ধরে অভিযোগ করে আসছিল যে, বাংলাদেশে ‘গুম’ একটি রাষ্ট্রীয় কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু পলাতক একজন প্রধানমন্ত্রী ও তার উপদেষ্টার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ এনে লিখিতভাবে তা কমিশনে পেশ করেছেন এই তরুণরা। এটি শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাই নয়, বরং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার্য মামলা হিসেবে গণ্য হতে পারে।
শেখ ওমর আরো বলেন, যেসব ভুক্তভোগী ফিরে এসেছেন, ভুক্তভোগী হিসেবে তাদের বক্তব্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে উঠবে।