ডিজিটাল যুগে মুসলিমদের করণীয়: প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা

মাওলানা শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে

একবিংশ শতাব্দী হলো প্রযুক্তির যুগ। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) পর্যন্ত, ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। মুসলিম হিসেবে আমাদের এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হচ্ছে এবং ইসলামের মৌলিক নীতিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবন পরিচালনা করতে হচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি একদিকে যেমন জ্ঞান ও যোগাযোগের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি নানারকম চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। একজন মুসলিমের জন্য এই যুগে করণীয় কী, তা কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ করা হলো।

১. জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তির ব্যবহার

ইসলাম জ্ঞান অর্জনের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে। ডিজিটাল প্রযুক্তি এই কাজটি অনেক সহজ করে দিয়েছে। এখন একজন মুসলিম সহজেই কোরআন, হাদিস এবং ইসলামিক বইপত্র অনলাইনে পড়তে পারে। ইসলামিক স্কলারদের লেকচার, আলোচনা এবং গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলো এখন হাতের মুঠোয়। ইন্টারনেটে হাজার হাজার ইসলামিক ওয়েবসাইট, অ্যাপ এবং ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে যা মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। একজন মুসলিম এই মাধ্যমগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে পারে এবং অন্যদের কাছেও ইসলামের সঠিক বার্তা পৌঁছে দিতে পারে।

২. দাওয়াহ বা ইসলাম প্রচার

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো দাওয়াহ’র (ইসলাম প্রচারের) এক বিশাল সুযোগ তৈরি করেছে। সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ, এবং অনলাইন ফোরামের মাধ্যমে মুসলিমরা ইসলামের সৌন্দর্য ও সঠিক শিক্ষা অন্যদের কাছে তুলে ধরতে পারে। এমনভাবে দাওয়াহ কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত, যা আক্রমণাত্মক না হয়ে বরং ভালোবাসা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে ইসলামের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন:

“তুমি তোমার প্রতিপালকের পথের দিকে আহ্বান করো হিকমত ও উত্তম উপদেশ দ্বারা, আর তাদের সাথে বিতর্ক করো উত্তম পন্থায়।” (সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১২৫)

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এই আয়াতের নির্দেশনা মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।

৩. মিথ্যা ও গুজবের বিরুদ্ধে সচেতনতা

ডিজিটাল যুগে তথ্য যেমন দ্রুত ছড়ায়, তেমনি মিথ্যা খবর ও গুজবও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একজন মুমিন হিসেবে আমাদের যেকোনো তথ্য যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করা উচিত। কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন:

“হে মুমিনগণ, যদি কোনো ফাসেক তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা যাচাই করে দেখো, যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বসো, ফলে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত হতে হয়।” (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ৬)

এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, যেকোনো খবর শেয়ার করার আগে তার সত্যতা যাচাই করা অপরিহার্য। মিথ্যা ও গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকা একজন মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব।

৪. অশ্লীলতা ও অপচয় থেকে দূরে থাকা

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো অনেক সময় অশ্লীলতা ও অনৈতিক কাজের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। একজন মুসলিমের জন্য এমন বিষয়বস্তু থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। এছাড়াও, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা এক ধরনের সময়ের অপচয়, যা ইসলামে অপছন্দনীয়। জীবনের সময় একটি মূল্যবান সম্পদ এবং এর সদ্ব্যবহার করা প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “দুনিয়াতে এমনভাবে জীবনযাপন করো, যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথচারী।” (সহীহ বুখারী) এর মাধ্যমে তিনি সময়কে অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহারের তাগিদ দিয়েছেন।

৫. ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও অনলাইন নিরাপত্তা

ডিজিটাল যুগে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়া একটি বড় ঝুঁকি। একজন মুসলিমের জন্য অন্যদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সম্মান করা এবং নিজের তথ্য সুরক্ষিত রাখা জরুরি। ইসলাম অন্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ গোপন করে রাখবেন।” (সহীহ মুসলিম) এই নীতি আমাদের অনলাইন জীবনেও প্রয়োগ করা উচিত।

ডিজিটাল প্রযুক্তিকে পুরোপুরি বর্জন করা এই যুগে সম্ভব নয়, এবং ইসলামও জ্ঞানের মাধ্যমকে নিরুৎসাহিত করে না। বরং একজন মুমিনের দায়িত্ব হলো এই প্রযুক্তিকে ইসলামের নীতি অনুসারে ব্যবহার করা। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হিসেবে, দাওয়াহ’র কাজে এবং সামাজিক যোগাযোগে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে পারলে এটি আমাদের জন্য কল্যাণকর হতে পারে। একই সাথে, এর চ্যালেঞ্জগুলো যেমন- মিথ্যা তথ্য, অশ্লীলতা এবং সময়ের অপচয় থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হবে। এই ডিজিটাল যুগে একজন মুসলিমের জীবন হবে ভারসাম্যপূর্ণ, যেখানে প্রযুক্তি হবে আল্লাহর পথে চলার একটি সহায়ক শক্তি, কোনো বাধা নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *