মাওলানা শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে
ইসলামে জুমার দিনটি মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। সাপ্তাহিক ঈদের দিন হিসেবে এই দিনটির রয়েছে এক অনন্য মর্যাদা এবং ফজিলত। আল্লাহ তা’আলা এই দিনটিকে মুমিনদের জন্য রহমত, বরকত ও ক্ষমা লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে দান করেছেন। জুমার দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে পবিত্র কুরআন ও অসংখ্য হাদিসে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
জুমার দিনের ফজিলত
সাপ্তাহিক ঈদের দিন: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জুমার দিনটি হলো সাপ্তাহিক ঈদের দিন, যা আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের জন্য নির্ধারণ করেছেন।” এই দিনটি অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি বরকতময়।
গুনাহ মাফের দিন: জুমার দিনে কিছু নির্দিষ্ট আমল করলে এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত সব সগিরা গুনাহ মাফ হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করবে, অতঃপর মসজিদে যাবে এবং চুপচাপ মনোযোগ সহকারে খুতবা শুনবে, তার এক জুমা থেকে অপর জুমা পর্যন্তকার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।”
দুনিয়া সৃষ্টির সূচনা এবং কিয়ামতের আগমন: জুমার দিনেই আল্লাহ তা’আলা আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এই দিনেই আদম (আ.)-কে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এই দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে। আর এই জুমার দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এই কারণে এই দিনটি একাধারে সৃষ্টি ও পরিণতির সাথে সম্পর্কিত।
বিশেষ দোয়া কবুলের সময়: জুমার দিনে একটি বিশেষ মুহূর্ত রয়েছে, যখন আল্লাহ তা’আলা বান্দার দোয়া কবুল করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জুমার দিনে এমন একটি মুহূর্ত আছে, যখন কোনো মুসলিম বান্দা সালাত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে কোনো কল্যাণ চাইলে তিনি অবশ্যই তাকে তা দান করেন।” এই বিশেষ মুহূর্তটি কখন, এ নিয়ে আলেমদের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে বেশিরভাগ আলেমদের মতে, এটি আসরের সালাতের পর থেকে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত।
জান্নাতের দরজা: জুমার দিন যারা নির্দিষ্ট কিছু আমল করে, তাদের জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, “যখন জুমার দিন আসে, তখন প্রতিটি মসজিদের দরজায় ফেরেশতারা বসে যায় এবং আগমনকারীদের নাম লিখে। যে ব্যক্তি প্রথমে আসে, সে যেন একটি উট কুরবানি করল। এরপর যে আসে, সে যেন একটি গরু, তারপর যে আসে, সে যেন একটি দুম্বা, তারপর যে আসে, সে যেন একটি মুরগি, তারপর যে আসে, সে যেন একটি ডিম কুরবানি করল। ইমাম খুতবা দেওয়ার জন্য বসলে তারা তাদের খাতা বন্ধ করে নেয়।”
জুমার দিনের করণীয় আমলসমূহ
জুমার দিনের ফজিলত লাভের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে, যা প্রত্যেক মুসলিমের পালন করা উচিত।
১. গোসল করা: জুমার দিনে গোসল করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ জুমার সালাতে আসে, তখন সে যেন গোসল করে।”
২. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া: গোসলের পর উত্তম পোশাক পরিধান করা এবং সুগন্ধি ব্যবহার করা মুস্তাহাব। রাসূল (সা.) জুমার দিনের জন্য উত্তম পোশাক ও সুগন্ধি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেছেন।
৩. আগে আগে মসজিদে যাওয়া: জুমার সালাতের জন্য আগে আগে মসজিদে যাওয়া অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। এতে ফেরেশতাদের খাতায় নাম অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সওয়াব বৃদ্ধি পায়।
৪. খুতবা মনোযোগ সহকারে শোনা: জুমার খুতবা সালাতের একটি অংশ। তাই খুতবার সময় চুপচাপ বসে মনোযোগ সহকারে শোনা জরুরি। খুতবা চলাকালে কথা বলা বা অন্য কোনো কাজে লিপ্ত থাকা মাকরুহ।
৫. সূরা কাহাফ তেলাওয়াত করা: জুমার দিনে সূরা কাহাফ তেলাওয়াত করার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জুমার দিনে সূরা কাহাফ তেলাওয়াত করবে, তার জন্য এক জুমা থেকে অপর জুমা পর্যন্ত নূর আলোকিত হবে।”
৬. বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা: জুমার দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করার নির্দেশনা রয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, “তোমাদের দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন হলো সর্বশ্রেষ্ঠ। এ দিনে তোমরা আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো।”
৭. বেশি বেশি নফল ইবাদত করা: জুমার দিনে অন্যান্য নফল ইবাদত যেমন নফল সালাত, কুরআন তেলাওয়াত ও জিকির-আজকার করা উচিত। বিশেষ করে আসরের সালাতের পর থেকে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত সময়টিতে দোয়া কবুলের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।
৮. দাড়ি কাটা ও নখ কাটা: জুমার দিন দাড়ি কাটা ও নখ কাটার সুন্নাত রয়েছে, যা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অংশ।
জুমার দিনটি একটি অনন্য নেয়ামত। এই দিনটিকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দিয়ে পালন করলে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি ও ক্ষমা লাভ করা সহজ হয়। এই দিনটির সঠিক ব্যবহার আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এক বিশেষ বরকত বয়ে আনতে পারে। আসুন, আমরা সকলে জুমার দিনের এই বিশেষ মর্যাদা উপলব্ধি করে এর আমলগুলো পালনে যত্নশীল হই।