গণমঞ্চ ডেস্ক নিউজ
শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে নারী মৃত্যুর হার দিন দিন বেড়েই চলছে। নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে নারীরা বেছে নিচ্ছে বিভিন্ন পথ। কেউ কেউ নির্যাতনের শিকার হয়ে সংসার ছাড়ছেন আবার কেউ বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ। আবার কেউ নিজের ভবিষ্যৎ ও সন্তানদের কথা ভেবে দিনের পর দিন নির্যাতন সহ্য করে আসছে। কিন্তু অনেকের আবার নিজের স্বামীর কাছেই বলি হতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি হত্যার ঘটনা ঘটেছে স্বামীর হাতে। স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতেও হত্যার শিকার হচ্ছেন। এমনকি নিজ পরিবারের সদস্যদের হাত থেকেও রক্ষা পাচ্ছেন না নারীরা।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় নারী সুরক্ষা হেল্পলাইন ‘১০৯’-এর তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার নারীরা সহায়তা চেয়ে কল করেছে অনেকবার। এবং তাদের কাছে কল এসেছে মোট ৪৮ হাজার ৭৪৫টি।
জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর তথ্য অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত নারী নির্যাতনের ঘটনায় কল এসেছে ১৭ হাজার ৩৪১টি। এর মধ্যে পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগের কল এসেছে অসংখ্যবার। শুধু স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগে কল এসেছে ৯ হাজার ৩৯৪টি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত অসংখ্য পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ৭ মাসে এই ঘটনা ঘটেছে ৩৬৩ টি। এর মধ্যে ২০৮ জন নারী ও শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। আর আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ১১৪ জন।
তারা বলছে, সবচেয়ে বেশি হত্যার ঘটনা ঘটেছে স্বামীর হাতে, ১৩৩ জন নারী এ হত্যার শিকার। ৪২ জন নারী স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে। আর ৩৩ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন নিজ পরিবারের সদস্যদের হাতে।
‘চুলায় রান্নার প্রস্তুতি চলছিল’
দুই বোনের মধ্যে বড় ছিলেন সৈয়দা ফাহমিদা তাহসিন (২৬)। ভিখারুননিসা নুন স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। পড়াশুনার পাশাপাশি বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি। ভালবেসে বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ের পর আর পড়াশুনা করা হয় নি তাঁর। ১২ বছরের সংসারে চার সন্তান রয়েছে। কিন্তু স্বামীর হাতেই বলি হতে হলো তাঁকে।
তাঁর পরিবার জানায়, সিফাত প্রায়ই তাঁকে মারধর করতেন। সন্তানদের কথা ভেবে সব মেনে সংসার করছিলেন তিনি। পরিবারের সদস্যরা ফাহমিদার বড় সন্তানের (১১) কাছ থেকে জানতে পারে। ফাহমিদার ফুপা মোঃ শামসুদ্দোহা খান বলেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে ফাহমিদা রান্না করছিলেন। এ সময় দুজনের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। ফাহমিদাকে মারধর শুরু করেন সিফাত। একপর্যায়ে তাঁকে ঘরের কক্ষে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন সিফাত। দিবাগত রাত প্রায় দুইটার দিকে ফাহমিদার পরিবারকে ফোন করেন সিফাত। তিনি বলেন, ‘কেয়া (ফাহমিদার ডাকনাম) অসুস্থ, আপনারা দ্রুত বাসায় আসেন।’ প্রথমে তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে পান্থপথের একটি বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বলা হয়। হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, ফাহমিদা আর বেঁচে নেই। সিফাতের দাবি ফাহমিদা আত্মহত্যা করেছেন। লাশ হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যান সিফাত। সন্তানদের বোনের বাসায় রেখে নিজেদের বাসা তালা দিয়ে যান।
পরিবারের সদস্যরা পুলিশ নিয়ে তালা ভেঙ্গে তাঁদের বাসায় ঢোকেন। বাসায় রান্নাঘরে রান্নার আয়োজন করে রাখা। চুলায় হাঁড়ি বসানো। হাঁড়িতে মাংস-মসলাপাতি দেওয়া। পরিবারের সদস্যরা বলেন, রান্নার আয়োজন চলা অবস্থায় সন্তানদের রেখে ফাহমিদা আত্মহত্যা করেছেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। থানায় মামলা কুরতে ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তবে ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে তাঁরা সন্দিহান। তাঁদের জানামতে, এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হননি।
মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাজ্জাদ রোমন বলেন, মামলাটি নিয়ে তদন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। প্রধান আসামিকে (সিফাত) গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এদিকে থানায় মামলা করতে ভুক্তভোগী পরিবারের বেগ পাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
পুকুরে মিলল স্ত্রীর লাশ
সিলেটের গোলাপগঞ্জে স্ত্রীকে হত্যা করে লাশ পুকুরে ফেলে দেয় স্বামী। গত ১৮ জুন এ ঘটনা ঘটে।ঘটনার পর স্বামী আনু মিয়া (৩৫) কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এ বিষয়ে গোলাপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মোল্লা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের দাম্পত্য কলহ চলছিল। নিহত নারীর গলায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
স্ত্রী-সন্তানসহ তিনজনের লাশ উদ্ধার
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রী, সন্তান ও স্ত্রীর বড় বোনকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। গত এপ্রিলে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হন স্বামী ইয়াছিন আলী।
পুলিশ বলে, উচ্ছৃঙ্খলতা ও ভাঙচুরের অভিযোগে তাঁর সৎমায়ের করা মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন। ইয়াছিন মাদকাসক্ত ও বখাটে ছিলেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর গত ৮ এপ্রিল ইয়াছিন তাঁর স্ত্রীর বোনের বাড়িতে যান। পারিবারিক কলহের একপর্যায়ে তিনি তাঁর স্ত্রী লামিয়া (২৩) ও স্ত্রীর বড় বোন সপ্না (৩৫) কে গলা কেটে ও শিশুসন্তান রাফসান (৪) কে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। তিনি লাশগুলো বস্তাবন্দী করে মাটিচাপা দেন।
‘সহিংস সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে’
ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমানে এ ঘটনা বেড়ে চলার পেছনে অন্যতম কারণ পারিবারিক সমস্যা, সামাজিক সচেতনতা, অর্থনৈতিক চাপ, দাম্পত্য কলহ, মাদকাসক্তি, যৌতুকপ্রথাসহ কঠোর আইনের অভাব ও প্রশাসনের দুর্বলতা। তাই এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। শুধু সামাজিক সচেতনতা বাড়ালেই হবে না পাশাপাশি পরিবারগুলোকেও সচেতন হতে হবে এবং প্রশাসনকে শক্ত হতে হবে, কঠোর নীতিমালা তৈরি করতে হবে ও নীতিমালার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কি না তা খেয়াল রাখতে হবে। তাহলেই নারীর প্রতি সহিংসতা ও মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হবে।