গাজায় দুর্ভিক্ষ ‘মানবতার ব্যর্থতা’, ‘মানবসৃষ্ট বিপর্যয়’: জাতিসংঘ মহাসচিব

গণমঞ্চ নিউজ ডেস্ক –

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গাজা শহর ও আশপাশের এলাকায় নিশ্চিত হওয়া দুর্ভিক্ষকে ‘মানবতার ব্যর্থতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি একে ‘মানবসৃষ্ট বিপর্যয়’ বলে উল্লেখ করেন।

এর আগে জাতিসংঘ-সমর্থিত সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) গাজার কিছু অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ধাপ ‘ফেজ ৫’-এ নেয়, যা দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে গুরুতর স্তর।

সংস্থাটি জানিয়েছে, গাজার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ বর্তমানে ‘বিপর্যয়কর’ অবস্থায় রয়েছে; তারা ‘অনাহার, চরম অভাব ও মৃত্যু্র’ মুখোমুখি।

তবে ইসরায়েল এই প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যা’ বলে দাবি করেছে এবং বলেছে, গাজায় দুর্ভিক্ষ নেই। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইসরায়েল এখনো ত্রাণ প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। যদিও ইসরায়েল তা অস্বীকার করেছে; কিন্তু ১০০টিরও বেশি মানবিক সংস্থা, প্রত্যক্ষদর্শী, জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা এবং ইসরায়েলের কয়েকটি মিত্র দেশের বক্তব্যের সঙ্গে এই দাবি সাংঘর্ষিক।

আইপিসি সতর্ক করে জানিয়েছে, ‘তাৎক্ষণিক ও ব্যাপক হস্তক্ষেপ’ না হলে দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যু ভয়াবহ রূপ নেবে। সংস্থার পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ দেইর আল-বালাহ ও খান ইউনিসে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়বে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তখন প্রায় ৬ লাখ ৪১ হাজার মানুষ—যা গাজার এক-তৃতীয়াংশ—’আইপিসি ফেজ ৫’-এর অধীনে ‘দুর্বিষহ পরিস্থিতি’তে পড়বেন। একই সময়ে প্রায় ১১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ পড়বেন ‘আইপিসি ফেজ ৪’-এর অধীনে ‘জরুরি পরিস্থিতি’র মুখে, যা গাজার প্রায় ৫৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী।

এ ছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার শিশু ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত অপুষ্টিজনিত ঝুঁকিতে পড়বে। গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, অপুষ্টিতে মারা গেছেন অন্তত ২৭১ জন, এর মধ্যে ১১২ জন শিশু।

২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত আইপিসি এখন পর্যন্ত মাত্র চারটি দুর্ভিক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত করেছে। সর্বশেষ দুর্ভিক্ষ ঘোষণা হয়েছিল ২০২৪ সালে সুদানে। তবে আইপিসি সরাসরি কোনো দেশকে দুর্ভিক্ষ কবলিত ঘোষণা করতে পারে না। সাধারণত এ ঘোষণা দেয় সংশ্লিষ্ট সরকার বা জাতিসংঘ।

গাজার পাঁচ সন্তানের জননী ৪১ বছর বয়সী রিম তাওফিক খাদের বলেন, ‘দুর্ভিক্ষ ঘোষণা অনেক দেরিতে এসেছে, তবে এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পাঁচ মাস ধরে কোনো প্রোটিন খাইনি। আমার সবচেয়ে ছোট সন্তান চার বছরের—সে জানেই না ফল বা সবজির চেহারা কেমন, স্বাদ কেমন।’

জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, গাজায় যে দুর্ভিক্ষ চলছে, তা পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য ছিল। তাদের অভিযোগ, ইসরায়েলের ‘পদ্ধতিগত বাধার’ কারণে খাদ্য গাজায় প্রবেশ করতে পারছে না। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য দুর্ভিক্ষ। ইসরায়েলের পরিকল্পিত বাধার কারণে খাদ্য ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে পৌঁছাতে পারছে না।’

মহাসচিব গুতেরেস বলেন, ‘গাজায় যে নরকযন্ত্রণার মতো পরিস্থিতি চলছে, তার বর্ণনা দেওয়ার মতো শব্দই যেন আর অবশিষ্ট নেই। এখন নতুন শব্দ যোগ হলো—দুর্ভিক্ষ। এটি কোনো রহস্য নয়, বরং মানুষের তৈরি বিপর্যয়, নৈতিকতার ব্যর্থতা এবং মানবতার জন্য কলঙ্ক।’ তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ইসরায়েলের স্পষ্ট দায়িত্ব রয়েছে গাজার জনগণের খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ নিশ্চিত করা।

জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)-এর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেন, ‘এটি পরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট অনাহার, যা ইসরায়েল সরকারের তৈরি।’ জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক বলেন, ‘দুর্ভিক্ষ ইসরায়েল সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের সরাসরি ফলাফল। তারা অবৈধভাবে গাজায় সহায়তা প্রবেশে বাধা দিয়েছে।’

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি একে ‘নৈতিক কলঙ্ক’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘ইসরায়েল সরকার গাজায় পর্যাপ্ত সহায়তা প্রবেশে বাধা দিয়েছে। এর ফলেই এই মানবসৃষ্ট বিপর্যয় ঘটেছে।’

অন্যদিকে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইসরায়েলের কোনো অনাহারের নীতি নেই। বরং ইসরায়েলের নীতি হলো অনাহার প্রতিরোধ করা। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েল ২০ লাখ টন সহায়তা গাজায় প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে, যা প্রতিজনের জন্য এক টনেরও বেশি।’

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে গাজায় সহায়তা পরিস্থিতি নিয়ে ইসরায়েল ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে। গত মাসে দীর্ঘ চাপের পর ইসরায়েলি সেনারা গাজায় আকাশপথে ত্রাণ ফেলে। তবে সাহায্য সংস্থাগুলো একে ‘নিষ্ঠুর প্রহসন’ বলে সমালোচনা করে।

গাজায় আকাশপথে ত্রাণ পৌঁছালেও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সতর্ক করা হয়েছে, কারণ এর আগে পড়ন্ত প্যালেটের আঘাত পেয়ে সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন। সপ্তাহের শুরুতে বিবিসি জানিয়েছে, অন্তত ১০ বার ত্রাণ এমন এলাকায় ফেলা হয়েছে, যেখানে প্রবেশ না করার জন্য ইসরায়েলি সেনারা স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছিল।

আকাশপথে ত্রাণ ফেলার পাশাপাশি ইসরায়েল বলেছে, জাতিসংঘের বহরের জন্য তারা মানবিক করিডর নির্ধারণ করবে। তবে মঙ্গলবার জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজায় যে অল্প সহায়তা ঢুকছে তা দিয়ে ‘ব্যাপক দুর্ভিক্ষ ঠেকানো সম্ভব নয়’। ইসরায়েলি সেনাদের ত্রাণ তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা কোগাত দাবি করছে, প্রতিদিন প্রায় ৩০০ ট্রাক ত্রাণ প্রবেশ করছে। কিন্তু জাতিসংঘের হিসাবে মানুষের চাহিদা মেটাতে দৈনিক ৬০০ ট্রাক প্রয়োজন।

এই পরিস্থিতিতে আইপিসি–এর প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো, যখন ইসরায়েল গাজা সিটি দখলের উদ্দেশ্যে নতুন সামরিক অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসরায়েলি সেনারা এই অভিযান শুরু করেছিল হামাসের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে চালানো হামলার জবাবে। ওই হামলায় প্রায় ১,২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।

এরপর থেকে গাজায় অন্তত ৬২ হাজার ১২২ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গাজার অধিকাংশ মানুষ একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ৯০ শতাংশেরও বেশি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যসেবা, পানি, স্যানিটেশন ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *