মাওঃ শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের পাশাপাশি সমগ্র সৃষ্টিজগতের ভারসাম্য রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে পরিবেশ সুরক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং প্রকৃতির প্রতি সদয় আচরণের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ইসলাম মনে করে, এই পৃথিবী আল্লাহ তা’আলার একটি পবিত্র আমানত, এবং মানুষ তার তত্ত্বাবধায়ক বা খলিফা হিসেবে এই আমানতের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দায়ী।
খিলাফতের দায়িত্ব ও প্রকৃতির ভারসাম্য
আল্লাহ তা’আলা মানবজাতিকে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসেবে পাঠিয়েছেন। এই দায়িত্বের প্রধান অংশ হলো আল্লাহর সৃষ্টিজগতের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং এতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, “আর পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তোমরা তাতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না।” (সূরা আল-আ’রাফ, ৭:৫৬)। এই আয়াতটি পরিবেশ দূষণ, বন উজাড়, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করার বিরুদ্ধে একটি কঠোর সতর্কবার্তা।
জীবজন্তু ও প্রাণীর প্রতি দয়া
ইসলামে জীবজন্তু ও প্রাণীর প্রতি দয়া দেখানোকে একটি ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) অসংখ্য হাদিসে প্রাণীর অধিকার ও তাদের প্রতি মানবিক আচরণের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, “এমন এক মহিলাকে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, যে একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল। সে তাকে খাবার দেয়নি, আর সে নিজে পোকামাকড় খেয়েও বাঁচতে পারেনি।” (বুখারি ও মুসলিম)। এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা ইসলামে কত বড় গুনাহ।
রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, “তোমরা জমিনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া করো, তাহলে আসমানের অধিবাসী (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।” (তিরমিজি)। এর মাধ্যমে তিনি সকল সৃষ্টির প্রতি দয়া ও করুণার শিক্ষা দিয়েছেন।
সম্পদ ও পানির ব্যবহার: অপচয় থেকে বিরত থাকা
ইসলাম প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে পানির অপচয়কে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “আর তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।” (সূরা আল-আ’রাফ, ৭:৩১)। এই নির্দেশনা শুধুমাত্র খাদ্য বা অর্থের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন—পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
রাসূল (সা.)-এর একটি প্রসিদ্ধ হাদিস রয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন, “যখন তুমি প্রবাহিত নদীর পাশেও ওজু করো, তখনো পানি অপচয় করো না।” (ইবনে মাজাহ)। এই হাদিসটি পানির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি আমাদের দায়িত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বৃক্ষরোপণ ও সবুজায়ন
বৃক্ষরোপণকে ইসলামে একটি পুণ্যের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যদি কিয়ামত শুরু হয়ে যায় এবং তোমাদের কারো হাতে একটি চারাগাছ থাকে, তাহলে সে যেন তা রোপণ করে।” (মুসনাদে আহমাদ)। এই হাদিসটি চরম সংকটেও প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি আরও বলেছেন, “যে কোনো মুসলিম একটি গাছ লাগায় অথবা শস্য রোপণ করে, আর তা থেকে কোনো পাখি, মানুষ বা জন্তু খায়, তবে তার জন্য তা সাদাকা হিসেবে গণ্য হবে।” (মুসলিম)।
ইসলামে পরিবেশ সুরক্ষা ও জীববৈচিত্র্য কেবল একটি সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি ঈমানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহর খলিফা হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলো এই পৃথিবীকে দূষণমুক্ত রাখা, বৃক্ষরোপণ করা, জীবজন্তুর প্রতি সদয় হওয়া এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি এবং একটি সুস্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারি।