মাওঃ শামীম হুসাইন, কেরানীগঞ্জ থেকে
ইসলামে জ্ঞানার্জন একটি মৌলিক ইবাদত এবং মানবজীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে সর্বপ্রথম যে শব্দটি ব্যবহার করে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ওহি নাযিল করেছিলেন, তা হলো “ইক্বরা” বা “পড়ো”। এটিই নির্দেশ করে যে, জ্ঞানার্জন ইসলামের মূল ভিত্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইসলাম জ্ঞানার্জনের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের ওপর সমানভাবে গুরুত্বারোপ করেছে। এটি শুধু পার্থিব জীবনের সাফল্যই নয়, বরং পরকালীন মুক্তিরও পথ।
জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব কুরআনের দৃষ্টিতে
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা অনেক স্থানে জ্ঞান ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের মর্যাদা তুলে ধরেছেন। সূরা আল-জুমার-এর ৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “বলো, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?” এই আয়াতটি স্পষ্ট করে যে, জ্ঞানী ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদাবান।
আল্লাহ আরও বলেছেন, “আল্লাহ তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেবেন, যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে।” (সূরা মুজাদালা, ৫৮:১১)। এই আয়াত প্রমাণ করে যে, জ্ঞান ঈমানকে আরও শক্তিশালী করে এবং এটি মর্যাদা বৃদ্ধির একটি মাধ্যম।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষায় জ্ঞানার্জন
রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও জ্ঞানার্জনের ওপর প্রচুর গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁর অসংখ্য হাদিস জ্ঞানার্জনের ফজিলত নিয়ে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর ফরজ।” (ইবনে মাজাহ)। এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, জ্ঞানার্জন কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়, বরং এটি প্রতিটি মুসলিমের জন্য আবশ্যক।
তিনি আরও বলেছেন, “যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে কোনো পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।” (মুসলিম)। এই হাদিসটি জ্ঞানার্জনের আধ্যাত্মিক সুফল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়। রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, “একজন আলেমের মর্যাদা একজন সাধারণ ইবাদতকারীর ওপর তেমনই, যেমন পূর্ণিমার রাতের চাঁদের মর্যাদা সকল তারকার ওপর।” (আবু দাউদ)।
জ্ঞানার্জনের প্রকারভেদ
ইসলামে জ্ঞানকে শুধু ধর্মীয় জ্ঞান হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। বরং, ইসলাম ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি পার্থিব জ্ঞান অর্জনেরও অনুপ্রেরণা দেয়। ধর্মীয় জ্ঞান যেমন—কুরআন, হাদিস, ফিকাহ—ঈমান ও ইবাদতের জন্য অপরিহার্য। তেমনি পার্থিব জ্ঞান যেমন—বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, প্রকৌশল—মানবজাতির কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলাম মনে করে, প্রতিটি জ্ঞানই আল্লাহর সৃষ্টি এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথ। তাই, যে জ্ঞান মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে এবং সমাজের কল্যাণে সাহায্য করে, তা সবই ইবাদতের অংশ।
জ্ঞানার্জনের সুফল ও দায়িত্ব
জ্ঞানার্জন শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর সুফল সমাজেও প্রতিফলিত হয়। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি একটি পরিবার, একটি সমাজ এবং একটি রাষ্ট্রকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। জ্ঞান মানুষকে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে এবং কুসংস্কার থেকে দূরে রাখে।
তবে, জ্ঞানার্জনের সাথে একটি বড় দায়িত্বও জড়িত। রাসূল (সা.) বলেছেন, “যখন কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি জিনিস ছাড়া: সদকায়ে জারিয়া, এমন জ্ঞান যা থেকে মানুষ উপকৃত হয়, এবং সৎ সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।” এই হাদিসটি থেকে বোঝা যায়, জ্ঞান মানুষকে মৃত্যুর পরও সওয়াব অর্জনের সুযোগ করে দেয়। তাই, জ্ঞান অর্জন করে তা সমাজের কল্যাণে বিতরণ করা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য।
ইসলামে জ্ঞানার্জন একটি পবিত্র কাজ, যা ঈমানের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এটি শুধু জ্ঞানীর মর্যাদা বৃদ্ধি করে না, বরং পুরো মানবজাতির উন্নতি ও অগ্রগতির জন্যও অপরিহার্য। তাই আমাদের উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জনের প্রতি সচেষ্ট থাকা এবং তা সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করা।