মাওঃ শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে
আধুনিক বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষ প্রতিনিয়ত উদ্বেগ, বিষণ্নতা, চাপ এবং মানসিক অস্থিরতার শিকার হচ্ছে। ইসলাম, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে, মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মিক প্রশান্তির বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, প্রকৃত মানসিক শান্তি আসে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন এবং তাঁর নির্দেশনা মেনে চলার মাধ্যমে। ইসলাম মনে করে, দেহ ও আত্মার সুস্থতা একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
১. মানসিক প্রশান্তির মূল উৎস:
আল্লাহর স্মরণইসলামের দৃষ্টিতে, মানসিক শান্তি লাভের সবচেয়ে বড় উপায় হলো আল্লাহর স্মরণ বা জিকির। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “সাবধান! আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্তি লাভ করে।” (সূরা রাদ, ১৩:২৮)। এই আয়াতটি স্পষ্ট করে যে, জাগতিক কোনো বস্তু বা কাজের মাধ্যমে নয়, বরং একমাত্র আল্লাহর স্মরণেই মানব হৃদয়ে প্রকৃত শান্তি আসে। সালাত (নামাজ), কুরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে পারে।
২. ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার গুরুত্ব
ইসলামে ধৈর্য (সবর) এবং কৃতজ্ঞতা (শুকর) মানসিক সুস্থতার দুটি শক্তিশালী স্তম্ভ। জীবনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “মুমিনের বিষয়টি কতই না বিস্ময়কর! তার জীবনের প্রতিটি ঘটনাই তার জন্য কল্যাণকর। যদি সে কোনো সুখ লাভ করে, সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে এবং তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি সে কোনো দুঃখ বা কষ্ট পায়, সে ধৈর্য ধারণ করে এবং এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়।” (মুসলিম)।এই হাদিসটি শিক্ষা দেয় যে, ভালো-মন্দ উভয় পরিস্থিতিতেই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ এবং ধৈর্যশীল থাকা উচিত। এটি মানুষকে মানসিক দৃঢ়তা দেয় এবং তাকে হতাশা থেকে রক্ষা করে।
৩. তাওবা ও ইসতিগফার:
মানসিক বোঝা থেকে মুক্তিপাপ বা ভুল করার পর মানুষের মনে এক ধরনের অপরাধবোধ ও মানসিক চাপ তৈরি হয়। ইসলামে তাওবা (অনুশোচনা) এবং ইসতিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) মানসিক চাপ দূর করার এক অসাধারণ পদ্ধতি। আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হৃদয়ে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করে দেন এবং এতে মন হালকা হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “আর তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, অতঃপর তাঁর দিকে ফিরে আসো। তিনি তোমাদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উত্তম ভোগসামগ্রী দান করবেন।” (সূরা হুদ, ১১:৩)। তাওবা মানুষকে মানসিক বোঝা থেকে মুক্ত করে নতুন করে শুরু করার সুযোগ দেয়।
৪. সামাজিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক সহায়তা
ইসলাম সামাজিক বন্ধন ও পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। যখন একজন ব্যক্তি অন্যদের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখে এবং একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসে, তখন তা তার মানসিক সুস্থতার জন্য উপকারী হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “এক মুমিন আরেক মুমিনের জন্য এক প্রাচীরের মতো, যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে।” (বুখারি)। সমাজে মানুষের সাথে মেলামেশা, তাদের কষ্ট দূর করা এবং একাকীত্ব দূর করা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫. শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্য
ইসলামে শরীর ও মনের ভারসাম্যপূর্ণ সুস্থতাকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলামের অনুশাসনগুলো যেমন—হালাল খাবার, পরিচ্ছন্নতা এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম—শারীরিক স্বাস্থ্যকে উন্নত করে, যা সরাসরি মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া, সালাতের শারীরিক ভঙ্গিগুলো এক ধরনের ব্যায়ামের কাজ করে, যা মন ও শরীর উভয়কেই সতেজ রাখে।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মিক প্রশান্তি কোনো জাগতিক সাধনা নয়, বরং এটি আল্লাহর নৈকট্য ও তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের ফল। আল্লাহর স্মরণ, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, ক্ষমা প্রার্থনা এবং সামাজিক বন্ধন—এই মূলনীতিগুলো মেনে চললে একজন ব্যক্তি যেকোনো ধরনের মানসিক চাপ ও অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে পারে। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় যে, জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা এবং তাঁর নির্দেশনা মেনে চলাতেই রয়েছে প্রকৃত শান্তি।