মাওঃ শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে
ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার ও সুবিচারের তাৎপর্য
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, যা জীবনের সকল ক্ষেত্রে ভারসাম্য ও ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা করার ওপর জোর দেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার (আদল) শুধু একটি আইনি ধারণা নয়, বরং এটি একটি মৌলিক ধর্মীয় এবং নৈতিক বাধ্যবাধকতা। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বারবার ন্যায়বিচারের গুরুত্ব, এর প্রয়োজনীয়তা এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য মুমিনদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ন্যায়বিচার আল্লাহর একটি গুণ
ন্যায়বিচার স্বয়ং আল্লাহ তা’আলার একটি গুণ। তিনি ‘আদল’ অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণ এবং ‘আল-হাকিম’ অর্থাৎ মহাবিচারক। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন…” (সূরা নাহল, ১৬:৯০)। এই আয়াতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে তাঁরই গুণ ধারণ করে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ করেন এবং কিয়ামতের দিন তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন, যেখানে কোনো ব্যক্তির ওপর বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না।
সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের ভিত্তি
ইসলামে ন্যায়বিচার কেবল ব্যক্তিগত আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি সুস্থ ও শান্তিময় সমাজের ভিত্তি। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত মদিনা সমাজ ছিল ন্যায়বিচারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি ধনী-গরিব, শক্তিশালী-দুর্বল, মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্য সমানভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকো, কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার করো—এটি আল্লাহভীতির নিকটতর।” (সূরা মায়িদা, ৫:৮)। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি ব্যক্তিগত শত্রুতাও ন্যায়বিচার থেকে বিরত থাকার কারণ হতে পারে না।
বিচারকের দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা
ইসলামে বিচারক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল পদ। বিচারকের ওপর সমাজের ন্যায় ও শৃঙ্খলা নির্ভর করে। তাই ইসলাম একজন বিচারককে সর্বোচ্চ সততা ও দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, “বিচারক তিন প্রকার। এক প্রকার বিচারক জান্নাতী এবং অপর দু’প্রকার বিচারক জাহান্নামী। জান্নাতী বিচারক হলো, যে সত্যকে বুঝে তদনুসারে ফায়সালা দেয়। আর যে বিচারক সত্যকে জানার পর স্বীয় বিচারে জুলুম করে, সে জাহান্নামী; এবং যে বিচারক অজ্ঞতাবশত ফায়সালা দেয়, সেও জাহান্নামী।” এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, সঠিক জ্ঞান ও সততার সাথে বিচার করা কত গুরুত্বপূর্ণ।
উত্তরাধিকার ও অর্থনৈতিক জীবনে ন্যায়
ইসলাম শুধু বিচারিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং উত্তরাধিকার, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য আর্থিক লেনদেনেও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামে সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য উত্তরাধিকার আইন অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এছাড়া, ওজনে কম দেওয়া, প্রতারণা করা বা কোনো ধরনের জালিয়াতি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এসব অনুশাসন সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাস বজায় রাখতে সহায়তা করে।
ইসলামে ন্যায়বিচার ও সুবিচার কেবল একটি আদর্শ নয়, বরং এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের একটি অপরিহার্য দিক। এটি ব্যক্তিগত চরিত্র, সামাজিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক লেনদেন এবং রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থাকে শৃঙ্খলিত করে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে একটি সমাজ আল্লাহ তা’আলার রহমত ও বরকত লাভে ধন্য হয় এবং জুলুম, বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি থেকে মুক্ত থাকে। একজন মুসলিমের জন্য ন্যায়বিচারের পথে চলা কেবল ধর্মীয় কর্তব্যই নয়, বরং এটি মানবতা ও সমাজের প্রতি তার গভীর দায়বদ্ধতারও প্রতিফলন।