মাওঃ শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে
ইসলামী অর্থনীতি একটি নৈতিক ও ন্যায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রচলিত পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও অন্যায্যতা যখন স্পষ্ট, তখন ইসলামী অর্থনীতির মডেল আধুনিক বিশ্বের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য একটি কার্যকর বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি
ইসলামী অর্থনীতির প্রধান উদ্দেশ্য হলো সমাজে সুবিচার, কল্যাণ ও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। এর কয়েকটি মূলনীতি নিচে তুলে ধরা হলো:
১. সুদ (রিবা) নিষিদ্ধকরণ: ইসলামী অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো সুদকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করা। সুদভিত্তিক লেনদেন ধনীকে আরও ধনী করে এবং গরিবকে ঋণের জালে আটকে ফেলে। এর পরিবর্তে ইসলাম মুনাফা ও লোকসানের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।” (সূরা আল-বাকারা, ২:২৭৫)।
২. যাকাত ও সাদকাহ: যাকাত হলো বিত্তবান মুসলিমদের ওপর বাধ্যতামূলকভাবে আরোপিত একটি আর্থিক ইবাদত, যা তাদের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরিব ও অভাবগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করতে হয়। এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে এবং সমাজের দুর্বল শ্রেণির মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করে। পবিত্র কুরআনে সালাতের পাশাপাশি যাকাতের কথাও বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, যা এর গুরুত্বকে প্রমাণ করে।
৩. প্রতারণা, জুয়া ও অনিশ্চয়তা (গারার) নিষিদ্ধকরণ: ইসলামী অর্থনীতিতে যেকোনো ধরনের প্রতারণা, জুয়া (মায়সির) এবং অতিরিক্ত অনিশ্চয়তাপূর্ণ (গারার) লেনদেন নিষিদ্ধ। এর উদ্দেশ্য হলো, লেনদেন যেন স্বচ্ছ, নির্ভরযোগ্য এবং সবার জন্য নিরাপদ হয়। এটি ফটকাবাজারি এবং অস্থিতিশীলতা থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করে।
৪. হালাল ও হারাম ব্যবসা: ইসলামী অর্থনীতিতে শুধুমাত্র হালাল (বৈধ) উপার্জনের অনুমতি রয়েছে। মদ, শুকরের মাংস, জুয়া বা অশ্লীলতার সাথে সম্পর্কিত যেকোনো ব্যবসা হারাম। এই নীতি নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতাকে ব্যবসার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গড়ে তোলে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক সংকট ও বৈষম্য ইসলামী অর্থনীতির প্রাসঙ্গিকতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
আর্থিক সংকট মোকাবিলা: ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকট প্রমাণ করেছে যে, সুদভিত্তিক ঋণ এবং ফটকাবাজারি একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। ইসলামী অর্থনীতির সুদবিহীন মডেল এবং ঝুঁকি-অংশীদারিত্বের নীতি এই ধরনের সংকট প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
দারিদ্র্য দূরীকরণ: বর্তমান বিশ্বে ধনী-গরিবের মধ্যে যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে, তা ইসলামী অর্থনীতির যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব। যাকাত একটি কার্যকর সামাজিক নিরাপত্তা জাল হিসেবে কাজ করে।
নৈতিক ব্যবসা ও কর্পোরেট দায়িত্ব: নৈতিকতা ও স্বচ্ছতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ইসলামী অর্থনীতির নীতিগুলো আধুনিক কর্পোরেট গভর্নেন্স এবং সামাজিক দায়িত্বশীলতার (CSR) ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ইসলামী অর্থনীতি কেবল একটি ধর্মীয় আর্থিক ব্যবস্থা নয়, বরং এটি একটি মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক মডেল, যা ব্যক্তি ও সমাজের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। এর মূলনীতিগুলো দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং আর্থিক অস্থিতিশীলতার মতো আধুনিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য একটি কার্যকর ও নৈতিক সমাধান দিতে সক্ষম।