মাওঃ শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে
আল্লাহ তাআলা মহাবিশ্বকে অপার জ্ঞান ও নিখুঁত পরিকল্পনার মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন। আকাশ, নক্ষত্র, নদী, সাগর, বৃক্ষ, প্রাণী—প্রত্যেকটি সৃষ্টিই মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। এর মধ্যে পর্বত একটি বিশেষ সৃষ্টিকর্ম, যা কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উৎস নয়; বরং পৃথিবীর ভারসাম্য, স্থিতিশীলতা ও মানব জীবনের উপযোগিতা নিশ্চিত করে। কুরআনুল কারীমে বহুবার পর্বতের উল্লেখ এসেছে, যা প্রমাণ করে যে ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
কুরআনে পর্বতের উল্লেখ
আল্লাহ তাআলা বহু আয়াতে পর্বতের কথা উল্লেখ করেছেন, যেমন—পৃথিবীর ভারসাম্যের জন্য “আর আমি পৃথিবীতে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেছি পর্বতমালা, যাতে তা তাদেরকে নিয়ে কাঁপতে না থাকে।” (সূরা আল-আম্বিয়া ২১:৩১)
পৃথিবীর পেরেকস্বরূপ “আমি কি পৃথিবীকে শয্যা এবং পর্বতমালাকে পেরেকস্বরূপ করিনি?” (সূরা আন-নাবা ৭৮:৬–৭)
জীবনধারণের জন্য পানি সংরক্ষণে
“আর আমি আকাশ থেকে বরকতময় পানি বর্ষণ করেছি, তারপর তার দ্বারা উদ্যান ও ফসল উৎপন্ন করেছি এবং খেজুরগাছ, যেগুলো উঁচু পাহাড়ে জমা হয়।” (সূরা ক্বাফ ৫০:৯-১০)
এই আয়াতগুলো ইঙ্গিত করছে যে পর্বত কেবল প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়; বরং পৃথিবীর স্থিতিশীলতা, পানির উৎস ও জীবনধারণের অপরিহার্য উপাদান।
হাদিসে পর্বতের গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জীবনীতে পর্বতের বিশেষ স্থান রয়েছে।
সীরাতের ঘটনা
নবুওয়াত লাভের আগে হেরা গুহায় (জাবালে নূর পাহাড়ে) তিনি ইবাদতে মশগুল থাকতেন। সেখানেই প্রথম ওহী নাযিল হয়। তায়েফ সফরের সময় পাহাড়ের ফেরেশতা রাসূল ﷺ-কে প্রস্তাব করেছিলেন, তিনি চাইলে ওই জাতিকে পাহাড় চাপা দিয়ে ধ্বংস করে দেয়া যেত। কিন্তু তিনি দোয়া করে তাদের জন্য হিদায়াত কামনা করেন।
হাদিসে উহুদ পাহাড়
রাসূল ﷺ বলেছেন: “এই উহুদ আমাদেরকে ভালোবাসে, আমরাও একে ভালোবাসি।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৪৮২) এ থেকে বোঝা যায়, ইসলামে পর্বতের প্রতি এক বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।
পর্বত: পৃথিবীর স্থিতিশীলতার প্রতীক
আধুনিক ভূবিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে পর্বত পৃথিবীর ভূত্বককে স্থিতিশীল রাখে। গভীরে গেঁথে থাকা শিকড়ের মতো এর অংশ পৃথিবীর প্লেটগুলোকে ভারসাম্য প্রদান করে। কুরআনে এই সত্য ১৪০০ বছর আগে ঘোষণা করা হয়েছে: “তিনি পর্বতমালা স্থাপন করেছেন পৃথিবীর উপর, যেন তা তোমাদের নিয়ে দুলতে না থাকে।” (সূরা লুকমান ৩১:১০)
পানি ও জীববৈচিত্র্যের উৎস হিসেবে পর্বত
পর্বতের বরফ ও হিমবাহ থেকে নদ-নদীর উৎপত্তি হয়, যা কৃষি, পানীয় জল ও জীবজন্তুর জীবনের প্রধান উৎস।
কুরআনে ইঙ্গিত এসেছে: “আর তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, তারপর তার দ্বারা বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেন।” (সূরা আন-নাহল ১৬:১০-১১)
বনভূমি, ওষধি গাছ, পাখি ও পশুপাখির আবাসস্থলও প্রধানত পর্বত অঞ্চল। ইসলামী শিক্ষায় পরিবেশ রক্ষার নির্দেশনা রয়েছে, আর পর্বত তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
পর্বত আধ্যাত্মিক সাধনার স্থান
পর্বত বহু নবীর জীবনে আধ্যাত্মিক গুরুত্ব বহন করে— মূসা (আ.) তূর পাহাড়ে আল্লাহর সাথে কথা বলেন। (সূরা আরাফ ৭:১৪৩) ঈসা (আ.) পর্বতে ইবাদতে নিভৃত থাকতেন। নবী মুহাম্মদ ﷺ হেরা গুহায় ইবাদত করতেন। এগুলো প্রমাণ করে যে পর্বত মানব আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের জন্য প্রশান্ত পরিবেশ প্রদান করে।
ইসলামে পর্বত থেকে শিক্ষণীয় দিক
১. দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের প্রতীক – মুসলমানের ঈমান পাহাড়ের মতো অটল হওয়া উচিত।
২. আল্লাহর নিদর্শন – পর্বতের দিকে তাকিয়ে মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির মহিমা অনুভব করে।
৩. সাধনাস্থল – নবী-রাসূলগণ নিভৃত সাধনার জন্য পর্বত বেছে নিয়েছিলেন।
৪. পরিবেশ সংরক্ষণ – ইসলামে গাছপালা কেটে ফেলার নিষেধাজ্ঞা আছে; তাই পর্বতাঞ্চলের বনভূমি রক্ষা করা এক ধরনের আমানত।
আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ ও কুরআনের সামঞ্জস্য
বিজ্ঞানীরা বলেছেন: পর্বত হচ্ছে টেকটোনিক প্লেটের চাপের ফল, যার গভীরে ‘শিকড়’ থাকে। এটি ভূমিকম্প হ্রাসে ভূমিকা রাখে। হিমবাহ ও ঝর্ণা বিশ্বজুড়ে মিঠা পানির প্রধান উৎস।
কুরআনের বাণীর সাথে বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারগুলো চমৎকারভাবে মিলে যায়, যা ইসলামের অলৌকিকতাকে প্রমাণ করে।
ইসলামে পর্বত শুধু প্রাকৃতিক সৃষ্টিই নয়, বরং আধ্যাত্মিক শিক্ষা, পৃথিবীর স্থিতিশীলতা, পানি সংরক্ষণ এবং মানব জীবনের জন্য অপরিহার্য উপাদান। কুরআনুল কারীম ও হাদিসে পর্বতের উল্লেখ আমাদের শেখায় যে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় এগুলোর ভূমিকা অনন্য। একইসাথে এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় আল্লাহর সৃষ্টির মহিমা ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার অপরিহার্যতা।
পরিশেষে বলা যায়, পর্বত কেবল ভৌগোলিক বা বৈজ্ঞানিক বিষয় নয়; বরং ইসলামের আলোকে তা আল্লাহর মহা নিদর্শন, যা মানুষের জীবন, আধ্যাত্মিকতা ও পরিবেশের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।