মাওঃ শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে
প্রচলিত পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের বাইরে ইসলামিক অর্থব্যবস্থা এক স্বতন্ত্র ও নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি অর্থনৈতিক মডেল। এটি কোনো বিশেষ গোত্র বা জাতির জন্য নয়, বরং মানবজাতির সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত একটি জীবনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাটির মূল উদ্দেশ্য হলো এমন একটি সমাজ গঠন করা, যেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না এবং প্রতিটি লেনদেন হবে ন্যায় ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে। প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় যেখানে মুনাফা অর্জনই প্রধান লক্ষ্য, সেখানে ইসলামিক অর্থব্যবস্থা সম্পদ বণ্টন ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়।
১. তাওহিদ ও আমানতদারির মূলনীতি
ইসলামিক অর্থব্যবস্থার সবচেয়ে মৌলিক ভিত্তি হলো তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস। এই বিশ্বাস অনুযায়ী, আসমান ও জমিনের সবকিছু এবং এর সকল সম্পদের চূড়ান্ত মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। মানুষ কেবল সেই সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক বা আমানতদার। এই ধারণা মানুষকে সম্পদ সঞ্চয় বা অপচয়ের পরিবর্তে সমাজের কল্যাণে তা ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে: “তিনিই সেই সত্তা যিনি পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ২৯)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, পৃথিবীর সম্পদ সবার জন্য, কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য নয়।
২. সুদ বা রিবার নিষিদ্ধতা
ইসলামিক অর্থব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো সুদ (রিবা) সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করা। সুদকে ইসলাম শোষণ, অন্যায় ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূল কারণ হিসেবে দেখে। যখন একজন ব্যক্তি ঋণ দিয়ে তার ওপর কোনো কাজ ছাড়াই অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে, তখন তা সম্পদকে কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা সুদকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন: “আর আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।” (সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ২৭৫)
এর বিপরীতে, ইসলামিক অর্থব্যবস্থা মুনাফা ও ঝুঁকির অংশীদারিত্বের ওপর ভিত্তি করে লেনদেন উৎসাহিত করে। এর ফলে বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা উভয়ই ঝুঁকি ও মুনাফা সমানভাবে ভাগ করে নেয়, যা প্রকৃত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করে।
৩. যাকাত ও দারিদ্র্য বিমোচন
যাকাত হলো ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ এবং ইসলামিক অর্থব্যবস্থার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি ধনী মুসলিমদের ওপর আরোপিত একটি বাধ্যতামূলক কর, যা প্রতি বছর তাদের সঞ্চিত সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ (সাধারণত ২.৫%) দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করতে হয়। যাকাত কেবল একটি আর্থিক ইবাদত নয়, বরং এটি একটি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যা সমাজে সম্পদ প্রবাহ নিশ্চিত করে। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন: “তাদের সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার।” (সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ১৯)
যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজে সম্পদ বৈষম্য কমে আসে এবং দরিদ্রদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
৪. গারার ও মাইসির-এর নিষিদ্ধতা
ইসলামী অর্থনীতিতে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ নিষিদ্ধ বিষয় হলো গারার (অতিরিক্ত অনিশ্চয়তা বা অনুমানভিত্তিক লেনদেন) এবং মাইসির (জুয়া বা ভাগ্য-পরীক্ষা)। জুয়াকে সম্পূর্ণ হারাম করা হয়েছে, কারণ এটি মানুষের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জনের পরিবর্তে ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। অন্যদিকে, গারার হলো এমন লেনদেন যেখানে পণ্যের বা মূল্যের কোনো নিশ্চিততা নেই, যেমন ফটকাবাজারি বা ফাটকা কেনাবেচা। এই দুটি নিষিদ্ধতার মাধ্যমে ইসলাম অর্থনৈতিক লেনদেনকে স্বচ্ছ, ঝুঁকি-মুক্ত এবং নৈতিকভাবে সুদৃঢ় করতে চায়।
৫. সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতা
ইসলামিক অর্থব্যবস্থায় মুনাফা অর্জনকে খারাপ চোখে দেখা হয় না, তবে তা অবশ্যই সমাজের কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। এখানে সম্পদের অপচয়, পরিবেশের ক্ষতি এবং ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। একজন মুসলিম উদ্যোক্তা কেবল নিজের লাভের জন্য কাজ করেন না, বরং সমাজ ও জনগণের প্রতি তার দায়বদ্ধতা অনুভব করেন। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি আর্থিক লেনদেনকে আখিরাতে জবাবদিহিতার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ফলে ব্যক্তি নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করতে বাধ্য হয়।
ইসলামিক অর্থব্যবস্থা একটি সামগ্রিক জীবন দর্শন, যা অর্থনীতিকে নৈতিকতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবকল্যাণের সঙ্গে যুক্ত করে। এটি কেবল কিছু নিয়ম-কানুনের সমষ্টি নয়, বরং এটি একটি নৈতিক কাঠামো যা সম্পদ বণ্টন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে নিশ্চিত করে। প্রচলিত অর্থব্যবস্থার সংকট মোকাবিলায় ইসলামিক অর্থব্যবস্থা একটি বাস্তবসম্মত ও টেকসই বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা যেখানে মানুষের প্রয়োজন পূরণ হবে, সম্পদ সুষমভাবে বণ্টিত হবে এবং প্রতিটি লেনদেন হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপর ভিত্তি করে।