আঙ্গুলের ছাপ: কোরআন, হাদিস ও আধুনিক বিজ্ঞান

মাওঃ শামীম হুসাইন কেরানীগঞ্জ থেকে

মানব শরীরের প্রতিটি অংশই আল্লাহ্‌র এক অনন্য সৃষ্টি। কিন্তু এর মধ্যে এমন একটি নিদর্শন রয়েছে যা মানুষকে একে অপরের থেকে আলাদা করে এবং আজকের আধুনিক বিজ্ঞানে যার গুরুত্ব অপরিসীম—তা হলো আঙ্গুলের ছাপ (Fingerprint)। পৃথিবীতে প্রায় ৮০০ কোটিরও বেশি মানুষ আছে, তবুও প্রত্যেকের আঙ্গুলের ছাপ একেবারেই আলাদা। কোরআনে আল্লাহ্‌ তা‘আলা এই বিশেষত্বের কথা ১৪০০ বছর আগেই ঘোষণা করেছেন, যখন মানুষ আঙ্গুলের ছাপ সম্পর্কিত কোনো ধারণাই রাখত না।

এই প্রতিবেদনে আমরা কোরআন-হাদিসের আলোকে আঙ্গুলের ছাপের গুরুত্ব, আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার, এবং এ থেকে মানবজাতির জন্য শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করবো।

আঙ্গুলের ছাপ সম্পর্কে কোরআনের ইশারা

আঙ্গুলের ছাপের প্রতি সরাসরি ইশারা করা হয়েছে সূরা আল-কিয়ামাহতে: بَلَىٰ قَـٰدِرِينَ عَلَىٰٓ أَن نُّسَوِّىَ بَنَانَهُۥ (القيامة: ٤)
অর্থ: “হ্যাঁ, আমি সক্ষম, এমনকি তার আঙ্গুলের ডগা পর্যন্ত সঠিকভাবে গড়ে তুলতে।” এখানে “بَنَانَهُ” শব্দের অর্থ আঙ্গুলের ডগা বা ফিঙ্গারটিপ। আধুনিক কালে আবিষ্কৃত হয়েছে যে আঙ্গুলের ডগায় থাকে মানুষের অনন্য পরিচয়—আঙ্গুলের ছাপ। কোরআন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, আল্লাহ্ কেয়ামতের দিনে মানুষের দেহ পুনরায় গঠন করবেন এমনকি তার আঙ্গুলের ছাপ পর্যন্ত ফিরিয়ে দেবেন।

এটি শুধু আঙ্গুলের ডগার পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতিই নয়, বরং মানুষের ব্যক্তিসত্তার নিখুঁত বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন।

হাদিসে আঙ্গুলের বিশেষত্ব

যদিও হাদিসে সরাসরি আঙ্গুলের ছাপের প্রসঙ্গ পাওয়া যায় না, তবে আঙ্গুলের গুরুত্ব নিয়ে রাসূল ﷺ বলেছেন: আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেন: “আমাকে আঙ্গুলগুলোর সমন্বয়ে (সিজদায়) সঠিকভাবে রাখা হয়েছে।” (সহীহ মুসলিম)

এখানে বোঝানো হয়েছে মানুষের আঙ্গুলগুলো ইবাদতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আঙ্গুলের প্রতিটি জোড়া (Joint) সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে যে, মানুষের প্রতিটি সন্ধির জন্য প্রতিদিন সদকা দিতে হয় (সহীহ মুসলিম, হাদিস: 1007)।

তাহলে বুঝা যায়, আঙ্গুল শুধু দেহের অংশ নয়; বরং ইবাদত ও মানবতার সেবায় গুরুত্বপূর্ণ।

আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আঙ্গুলের ছাপ

আঙ্গুলের ছাপ হলো Dermatoglyphics বা চামড়ার রেখা। এর বৈশিষ্ট্য হলো:

অনন্যতা (Uniqueness):
পৃথিবীর কোনো দু’জন মানুষের আঙ্গুলের ছাপ এক নয়—even অভিন্ন যমজদেরও না।

অপরিবর্তনীয়তা (Permanency):
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষের আঙ্গুলের ছাপ অপরিবর্তিত থাকে। চামড়া কেটে গেলে নতুন চামড়া জন্মালেও ছাপের রেখাগুলো আবার একইভাবে ফিরে আসে।

শ্রেণিবিন্যাস (Classification):
আঙ্গুলের ছাপ সাধারণত তিন প্রকার—Loops, Whorls, Arches। এগুলোকে পুলিশি তদন্ত ও ফরেনসিক বিজ্ঞানে অপরাধী শনাক্তে ব্যবহার করা হয়।

অপরাধ তদন্তে ব্যবহার:
১৯শ শতকের শেষের দিকে প্রথমবারের মতো আঙ্গুলের ছাপকে অপরাধ তদন্তে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আজ FBI এবং বিশ্বের প্রতিটি নিরাপত্তা সংস্থা এটি ব্যবহার করছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা:
স্মার্টফোন, বায়োমেট্রিক এটিএম, ডিজিটাল সিগনেচার—সবখানেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে।

বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও কোরআনের সত্যতা

Sir Francis Galton (১৯শ শতক) প্রমাণ করেন যে আঙ্গুলের ছাপ মানুষের জন্য একক পরিচয় বহন করে। ডঃ হেনরি ফাউল্ডস 1880 সালে জাপানে বসবাসকালে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রথম ব্যাখ্যা দেন যে আঙ্গুলের ছাপ অপরিবর্তনীয় এবং শনাক্তকরণে ব্যবহারযোগ্য। আজকের DNA টেস্টিং এবং Biometric Identification প্রযুক্তিতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট একটি অপরিহার্য মাধ্যম।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যখন মানবজাতি এসব জানত না, তখন কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে যে আল্লাহ মানুষকে এমনকি তার আঙ্গুলের ডগাসহ পুনরায় গঠন করবেন।

বাস্তব উদাহরণ

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী: অপরাধী শনাক্তে আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ পুলিশেও ক্রিমিনাল রেকর্ড রাখতে AFIS (Automated Fingerprint Identification System) ব্যবহৃত হচ্ছে।

জাতীয় পরিচয়পত্র: বাংলাদেশের স্মার্ট NID কার্ডে নাগরিকদের আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণ করা হয়েছে।

ইমিগ্রেশন সিস্টেম: সৌদি আরবসহ বহু দেশে প্রবেশে আঙ্গুলের ছাপ বাধ্যতামূলক।

ব্যাংকিং ও মোবাইল সিকিউরিটি: বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশনে আঙ্গুলের ছাপ অপরিহার্য।

আঙ্গুলের ছাপ থেকে শিক্ষা

আল্লাহ্‌র সৃষ্টির নিখুঁততা: মানুষের শরীরের ক্ষুদ্রতম অংশেও আল্লাহ্‌র কুদরতের নিদর্শন বিদ্যমান।

দায়বদ্ধতা: কেয়ামতের দিন প্রতিটি ব্যক্তিকে তার পরিচয়সহ পুনরুত্থিত করা হবে।

ইমানের দৃঢ়তা: বিজ্ঞানের অগ্রগতি কেবল কোরআনের সত্যতাকে প্রমাণ করে।

নৈতিক শিক্ষা: প্রতিটি অপরাধ লুকানো সম্ভব নয়। যেমন আঙ্গুলের ছাপ মানুষের পরিচয় ফাঁস করে, তেমনি কেয়ামতের দিন মানুষের সকল কাজ প্রকাশ পাবে।

আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে কোরআনের ঘোষণা একদিকে আল্লাহ্‌র সৃষ্টির মহিমা প্রদর্শন করে, অন্যদিকে মানুষের জন্য প্রমাণ করে যে—কোরআন কখনো মানুষের রচিত গ্রন্থ হতে পারে না। কারণ ১৪০০ বছর আগে যখন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ছিল না, তখনই আল্লাহ্‌ ঘোষণা করেছেন যে মানুষের আঙ্গুল পর্যন্ত পুনর্গঠন সম্ভব।

আজকের আধুনিক বিজ্ঞান কোরআনের এই সত্যকে প্রমাণ করেছে। তাই আমাদের জন্য শিক্ষা হলো—আল্লাহ্‌র কিতাবের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা এবং তাঁর নিদর্শনগুলো থেকে ঈমান শক্তিশালী করা।

Share this post:

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *